আল্লাহর রাসুলের (সা.) জীবনকালে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তাকে সহযোগিতা করেছেন এবং তার ওফাতের পর সারা পৃথিবীতে ইসলামের আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছেন, যাদের রক্ত, ঘাম, জীবন, শ্রম ও বিপুল ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে ইসলাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, তারাই আল্লাহর রাসুলের (সা.) সাহাবি। নবি-রাসুলগণের পরে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ তারা। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আল্লাহর রাসুলের (সা.) প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অংশ এবং ইমানের দাবি।
সাহাবিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পুরুষ ও নারী দুনিয়াতেই নবিজির (সা.) মাধ্যমে জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। অনেকের মৃত্যু বা শাহাদাতের পর নবিজি (সা.) অন্যান্য সাহাবিদের জানিয়েছেন যে, তিনি জান্নাত লাভ করেছেন। এ রকম সাহাবির সংখ্যা ১০ জন নয়, বরং আরও অনেক বেশি।
তবে জান্নাতের সুংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি হিসেবে ১০ জন শ্রেষ্ঠ সাহাবির নাম বিশেষভাবে আলোচিত হয় কারণ একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে নবিজি (সা.) একসাথে তাদের নাম বলেছেন এবং সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন তারা জান্নাতি। আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আবু বকর জান্নাতি, ওমর জান্নাতি, ওসমান জান্নাতি, আলী জান্নাতি, তালহা জান্নাতি, জুবায়ের জান্নাতি, আবদুর রহমান ইবনে আওফ জান্নাতি, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস জান্নাতি, সাঈদ জান্নাতি এবং আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ জান্নাতি। (সুনানে তিরমিজি: ৩৭৪৭)
আমরা এখানে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত এই ১০ সাহাবির সংক্ষীপ্ত পরিচয় তুলে ধরছি-
১. আবু বকর সিদ্দিক (রা.)
ইসলামের প্রথম খলিফা এবং পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হজরত আবু বকর (রা.)। তার আসল নাম আবদুল্লাহ ইবনে ওসমান ইবনে আমর। উপাধি আতিক ও সিদ্দিক। মায়ের নাম উম্মুল খায়র। তার হাতে হজরত ওসমান ইবনে আফফান, হজরত জুবায়ের, হজরত তালহা, হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফের মতো বড় বড় সাহাবিরা ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হিজরতের সময় রাসুলুল্লাহর (সা.) সঙ্গী ছিলেন। নবিজির (সা.) মৃত্যুর পর ২ বছর মুসলমানদের খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি ইন্তেকাল করেন।
২. ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা ইসলামকে শক্তিশালী করেছিলেন। নবিজির (সা.) নবুয়্যত লাভের কয়েক বছর পর ইসলাম গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে সাহাবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে আবু বকরের (রা.) পরই তার নাম উচ্চারিত হতো। আবু বকরের ইন্তেকালের পর তিনি খলিফা হন এবং প্রায় সাড়ে দশ বছর খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার খেলাফতকালে খেলাফাতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। সাসানীয় সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
৩. ওসমান ইবনে আফফান (রা.)
ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.) আবু বকরের (রা.) ইসলাম গ্রহণের কিছুদিন পর তার দাওয়াতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নবিজির (সা.) জামাতা ছিলেন। প্রথমত তিনি নবিজির (সা.) মেয়ে রুকাইয়াকে বিয়ে করেন, রুকাইয়ার ইন্তেকালের পর উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেন। নবিজির (সা.) দুই মেয়েকে বিয়ে করার কারণে তাকে ‘জিন্নুরাইন’ বা দুটি নুরের অধিকারী বলা হতো। ওমরের (রা.) ওফাতের পর তিনি মুসলমানদের খলিফা হন এবং প্রায় বারো বছর খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
৪. আলি ইবনে আবু তালিব
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলি ইবনে আবু তালিব (রা.) ছিলেন নবিজির (সা.) চাচাতো ভাই। তিনি নবিজির (সা.) পরিবারে তার সন্তানের মতো প্রতিপালিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নবিজির (সা.) সবচেয়ে প্রিয় মেয়ে ফাতেমাকে (রা.) বিয়ে করেন। ইসলামের আবির্ভাবের পর বালকবয়সেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বীর যোদ্ধা। বদর, ওহুদ, খন্দক ও খারবারের যুদ্ধে তিনি অনন্য বীরত্বের পরিচয় দেন। ওসমানের (রা.) শাহাদাতের পর তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
৫. তলহা ইবনে উবাইদুল্লাহ
হজরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ (রা.) ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামগ্রহণকারী সাহাবিদের অন্যতম। ওহুদ যুদ্ধে নবিজিকে (রা.) রক্ষা করার জন্য তিনি অনন্য বীরত্বের পরিচয় দেন। নবিজির (সা.) আসা তীর ও তরবারির প্রায় চব্বিশটি আঘাত তিনি নিজের শরীরে নেন। হজরত আলীর (রা.) খেলাফতকালে জামাল যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
৬. জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.)
হজরত জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.) ছিলেন নবিজির (সা.) আপন ফুফু সাফিয়্যার ছেলে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হাবাশায় হিজরত করেছিলেন। পরবর্তীতে মদিনায় হিজরত করেন। নবিজির (সা.) সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি অনন্য বীরত্বের পরিচয় দেন। হজরত আলীর (রা.) খেলাফতকালে জামাল যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
৭. আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)
আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) ইসলামের প্রাথমিক যুগে হজরত আবু বকরের (রা.) দাওয়াতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী আট সাহাবির অন্যতম। তিনিও হাবশায় হিজরত করেছিলেন। পরবর্তীতে মদিনায় হিজরত করেন। হজরত ওমর (রা.) যে ছয়জন ব্যক্তিকে তার পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) ছিলেন তাদের অন্যতম। হজরত ওসমানকে (রা.) খলিফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৩১ হিজরিতে ৭২ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।
৮. সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)
হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) ইসলামের প্রার্থমিক যুগে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। ইসলামের পক্ষে প্রথম তীর নিক্ষেপ করেছিলেন তিনি। বদর, ওহুদসহ নবিজির নেতৃত্বে হওয়া প্রতিটি যুদ্ধে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। হজরত ওমরের (রা.) শাসনকালে তার নেতৃত্বে মুসলমান সেনাবাহিনী সাসানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী জয় করে। ৫৫ হিজরিতে ৮৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।
৯. সাঈদ ইবনে জায়েদ (রা.)
হজরত সাঈদ ইবনে জায়েদ (রা.) প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবিদের অন্যতম। ইসলাম গ্রহণের আগেও তিনি পৌত্তলিকতামুক্ত ছিলেন। তিনি হজরত ওমরের (রা.) বোন ফাতেমা বিনতে খাত্তাবের স্বামী ছিলেন। বদর যুদ্ধ ছাড়া অন্য সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। হজরত মুয়াবিয়ার (রা.) শাসনামলে ৮০ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।
১০. আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.)
হজরত আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হাবাশা ও মদিনায় হিজরত করেন। নবিজির (রা.) নেতৃত্বে হওয়া প্রায় সব যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। হজরত ওমরের (রা.) খেলাফতকালে তিনি মুসলমানদের একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। তার নেতৃত্বে মুসলমানরা ইয়ারমুকের ময়দানে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। তার নেতৃত্বে সিরিয়াসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর বিজিত হয়। হজরত ওমরের (রা.) খেলাফতকালেই প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন।