জুলাই আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরের দিনটি ছিল ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। ওই দিনই ছাত্রশিবির নয় দফা দিয়ে সামনে আসে এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয় বলে দাবি করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক কেফায়েত শাকিল।
১৯ জুলাই তৎকালীন সরকারের তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ, হাসনাত ও সারজিস আট দফা দাবি ঘোষণা করেন। পরদিন ২০ জুলাই শুধুমাত্র কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি পালন করা হবে বলে তারা জানান। কিন্তু এ ঘোষণা মুহূর্তেই আন্দোলনকামী ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি করে।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে কেফায়েত শাকিল লেখেন, ঢাকার রাস্তায় যখন মৃত্যুর মিছিল চলছিল, তখন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন তিনজন ২০ জুলাই কালো ব্যাজ কর্মসূচির বাইরে আর কিছুই ঘোষণা করলেন না। আমার সহকর্মী সাদ্দাম হোসাইন তখন কেঁদে ফেলেছিলেন। বলছিলেন, এত লাশের পর এই কর্মসূচি জাতির সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।
এই হতাশার মুহূর্তে হঠাৎই আসে ‘নয় দফা’র খবরে নাটকীয় মোড়। সাংবাদিক শাকিল জানান, কালবেলা পত্রিকার সাংবাদিক ও তার সাবেক সহকর্মী অন্তু মুজাহিদ ফোনে তাকে নয় দফার বিষয়ে অবহিত করেন। পরে একটি নাম্বার থেকে তার কাছে এমএমএস আকারে নয় দফা আসে, যেটি পাঠিয়েছিলেন আব্দুল কাদের।
তিনি বলেন, নয় দফা পাওয়ার পর আমি সেই নাম্বারে ফোন করি, মাহাদী নামে একজনের মাধ্যমে আব্দুল কাদেরের নাম্বার পাই। কাদের আমাকে জানান, ‘আট দফা নয়, নয় দফাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত’ এবং ‘আট দফা যারা দিয়েছে, তারা আমাদের প্রতিনিধি নয়।’ এরপর আমরাই মিডিয়ায় নয় দফা ছড়াতে শুরু করি।
শাকিল আরও বলেন, আমরা সাংবাদিকরা নিজেরাই মিডিয়া হাউজগুলোকে প্রেস রিলিজ, ভিডিও সিডি দিয়ে অনুরোধ করি নয় দফা প্রচার করার জন্য। এই কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারিনি, আমরা তখন ছাত্রশিবিরের মিডিয়া বিভাগের সহায়ক হয়ে উঠেছি।
ফেসবুক পোস্টে কেফায়েত শাকিল স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘মূলত সেদিনই ছাত্রশিবির আন্দোলনটা নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। তখন আমরা জানতাম না আন্দোলনের পেছনে কারা। পরে জানি, যাদের আমরা চিনতাম সাদিক বা সালমান নামে, আসলে ছিলেন সাদিক কায়েম। সিবগাতুল্লাহ ও আব্দুল কাদের ছিলেন বাস্তব আন্দোলনের পরিচালক।’
‘সেদিন থেকে আন্দোলনের অনেক কিছুতে আমাদের সাংবাদিকদেরও সম্পৃক্ততা শুরু হয় আমরা না জেনেই শিবিরের সার্কেলে ঢুকে যাই,’ বলেন তিনি।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে কেফায়েত শাকিল জানান, পদে না থেকেও ১৯ জুলাই থেকে ১ দফা ঘোষণা আসা পর্যন্ত আন্দোলনের প্রকৃত সমন্বয় করেন সাদিক কায়েম ও সিবগাতুল্লাহ। আর মাঠের নেতৃত্ব দেন আব্দুল হান্নান মাসুদ, রিফাত রশিদ ও আব্দুল কাদের।
তিনি উল্লেখ করেন, সম্ভবত ১ আগস্ট রাতে সিবগাতুল্লাহ আমাকে বলেন, ‘এই সপ্তাহেই শেখ হাসিনাকে আমরা তাড়াবোই।’ সেই মন্তব্যের চারদিন পরেই ঘটে সেই বহুল আলোচিত ঘটনা।
তিন সমন্বয়কের মধ্যে অন্যতম নাহিদের ভূমিকা নিয়ে শাকিল বলেন, ‘নাহিদদের অবদান ও ত্যাগ অবশ্যই ছিল, সেটা অস্বীকার করলে জুলুম হবে। কিন্তু এখন তারা যেভাবে ‘ক্রেডিট’ ভাগাভাগি নিয়ে লড়াই করছেন, এতে জাতীয় ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বিভাজনের ফলে পরাজিত শক্তিরাই লাভবান হচ্ছে।’
তিনি আরও লেখেন, ২০ জুলাইয়ের পর থেকে নাহিদ আর মাঠে ছিলেন না বলেই অনেকে মনে করেন। বরং পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থাতেই আন্দোলন প্রত্যাহারের লিখিত বার্তাও তারা দিয়েছিলেন। যদি সেদিন সাদিক ও তার টিম আন্দোলনকে ধরে না রাখত, তাহলে সেই ঘোষণাতেই আন্দোলনের কবর রচনা হয়ে যেত।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া তার এই পোস্টে শাকিল নিজেই স্বীকার করেছেন, আমরা সাংবাদিকরাও আন্দোলনের অনেক কিছুতে যুক্ত হয়েছিলাম এমনকি না বুঝেই শিবিরের পক্ষ হয়ে কাজ করেছি। কিন্তু তখন আর কোনো শক্তিই সামনে ছিল না। মিডিয়াতে ছাত্রদের কণ্ঠ তুলে ধরার জন্য আমরা তাদের দ্বারস্থ হয়েছিলাম।
কেফায়েত শাকিলের এই বিস্তৃত বয়ান আন্দোলনের ভেতরের বহু অজানা তথ্য সামনে নিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু সাংবাদিকতার একটি মূল্যবান দলিল নয়, বরং আগামী দিনের গবেষণার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি লেখেন, ‘আমি জানি, এই সত্য অনেকের কাছে অপছন্দনীয় হতে পারে। কিন্তু ইতিহাস ভুলে গেলে বিভ্রান্তিই জন্ম নেয়। তাই আমার দেখা সত্যটা না লিখে পারলাম না।