ঢাকা সোমবার, ৩০ জুন, ২০২৫

ফারুক পরিবারের সামিট গ্রুপে বিদ্যুৎ খাত ধ্বংস

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২৪, ১০:১০ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঢাকা: ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের ঘনিষ্ঠ সহচর গোপালগঞ্জ-১ আসনের (মুকসুদপুর ও কাশিয়ানী উপজেলার ৭ ইউনিয়ন) সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) মুহাম্মদ ফারুক খান এবং সহোদর আজিজ খানের সামিট গ্রুপ গত দেড় দশকে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে ধ্বংস করেছে।

শেখ পরিবারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ কোটি টাকা লুটপাট করেছে। স্বৈরাচার হাসিনার মন্ত্রী ফারুক খানের ভাই এদেশে ব্যবসা করে সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ১০ ধনীদের একজন। যদিও ফারুক-আজিজ পরিবারের সামিট গ্রুপের সেখানে কোনো ব্যবসা নেই। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে টাকা পাচার করে সিঙ্গাপুরে বিলিয়নিয়র বনে গেছেন।

সামিট গ্রুপকে সুবিধা দিতে হাসিনা সরকার একাধিকবার দেশের স্বার্থ না দেখে আইন পরিবর্তন করেছেন। যাতে সরকারে ক্ষতির পরিমাণ লাখ লাখ কোটি টাকা। রাষ্ট্রের ক্ষতি হলেও ফারুক খান এবং আজিজ খানের পরিবার বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সামিট গ্রুপের ব্যবসার সঙ্গে শেখ হাসিনা-রেহানা এবং সজীব ওয়াজেদ জয়ের যোগসূত্র রয়েছে।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সামিট গ্রুপের। শেখ পরিবারের সহায়তায় ফারুক-আজিজ সহোদরের দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বিগত সরকারের আমলে যেসব খাতে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে তার মধ্যে বিদ্যুৎ খাত অন্যতম। এর নেতৃত্বে ছিল সামিট গ্রুপ। কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়াই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, বিশেষ আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের নামে হাজার কোটি টাকা পাচারসহ টেন্ডার ছাড়া জ্বালানি অবকাঠামো খাতে বড় বড় প্রকল্পের অনুমোদন বাগিয়ে নেয় সামিট।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইন ২০১০ পাস করা হয়। এতে যেসব সুবিধা রাখা হয় তার পুরোটাই ভোগ করেছে সামিট পাওয়ার। কুইক রেন্টাল চালুসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান যার মধ্যে অন্যতম। এমনকি সে সময় এসব আইনের বিরোধিতা যারা করেছিল তাদের চাকরিচ্যুত এবং পদাবনতি করা হয়েছে। এককথায় সামিট পাওয়ারকে সুবিধা দিতেই বিদ্যুৎ আইন সংশোধন করা হয়।

এদিকে সামিট গ্রুপের ব্যবসা মূলত বাংলাদেশকেন্দ্রিক হলেও গ্রুপটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর হোল্ডিং কোম্পানি ‘সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল’ নিবন্ধিত হয়েছে সিঙ্গাপুরে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের বড় অংশই দেশের কাজে আসেনি এবং এই বিদেশি নিবন্ধন থাকার কারণে টাকা পাচারের সুযোগও পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

অন্যদিকে গত ১০ বছরে চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করে বিগত সরকার। যার মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মোটা অঙ্কের ঋণের ব্যবস্থাও করে সাবেক সরকার। এমনকি বেসরকারি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহের দায়িত্ব নেয় জ্বালানি বিভাগ। আর সরকার যদি জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারে তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বড় অঙ্কের টাকা দিতে হতো তাদের।

শুধু তাই নয়, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যে ঋণ নেওয়া হয়েছে তার গ্যারেন্টর থাকত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এমন সব জনবিরোধী আইন করে সামিটসহ সাবেক সরকারের অধীনস্ত কর্তা-ব্যক্তিদের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে দেওয়া হয় বিশেষ সুবিধা।

সর্বশেষ দেশের জ্বালানি সংকট প্রকটকালেও বিশেষ করে গ্যাস সংকটের মধ্যে গত বছর নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে সামিটকে প্রায় ৬০০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয় সরকার। আশপাশের সব শিল্প-কারখানা যখন গ্যাসের অভাবে বন্ধ তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে সামিটকে এই গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের জন্য কুমিল্লা থেকে মেঘনা ঘাট পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার।

অভিযোগ রয়েছে, দেশের জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যের। অন্যদিকে দেশের একমাত্র এলএনজি টার্মিনালের মালিক যেহেতু সামিট, তাই গ্যাসের দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি না করে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর জন্যও এই প্রতিষ্ঠানটির দায় রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কক্সবাজারের মহেশখালীতে হতে যাওয়া দেশের তৃতীয় ভাসমান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কোনোরকম দরপত্র ছাড়াই বিশেষ আইনের আওতায় চলতি বছরে ৩০ মার্চ সামিট গ্রুপের সঙ্গে চুক্তিটি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

মূলত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সামিট তার ব্যবসা বাড়াতে থাকে বাংলাদেশে। বিশেষ করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) ও এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের ক্ষেত্রে সামিটের প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বেশি। নানা মাত্রায় দেওয়া হয়েছে কর ও শুল্ক সুবিধা। এর ধারাবাহিকতায় গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে একক আধিপত্য চলে সামিট গ্রুপের। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বড় কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম দাঁড় করাতে না পারলেও বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করেছে দাপটের সঙ্গে। আইনি ইনডেমনিটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনুকূল চুক্তির সুবাদে ক্যাপাসিটি চার্জ ও বিক্রয় মূল্যসহ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া আয়ই হয়ে উঠেছে তাদের ব্যবসার বড় ভিত্তি।

এদিকে, গ্রেপ্তারকৃত আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান এবং ড. আব্দুর রাজ্জাককে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার পৃথক শুনানিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক এ আদেশ দেন।

মকবুল নামে এক বিএনপিকর্মী গুলিতে মৃত্যুর মামলায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খানকে ২ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।

গতকাল শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ছানাউল্ল্যা আসামির দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পল্টন থানার এসআই নাজমুল হাসান ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ রিমান্ডের পক্ষে অবস্থান নেন।

সোমবার (১৪ অক্টোবর) রাতে ঢাকার বাসা থেকে ফারুক খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর বিএনপির একদফা দাবি আন্দোলন কর্মসূচি ঘিরে সারা দেশের নেতাকর্মীরা যখন নয়াপল্টনে জড়ো হতে থাকেন, তখন আসামিরা বিএনপির সমাবেশ বানচালের সিদ্ধান্ত নেন। অজ্ঞাতনামা ৫০০-৬০০ আসামি বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তারা বিএনপি অফিসে প্রবেশ করে ভাঙচুর করেন। বিএনপি কার্যালয়ে থাকা নেতাকর্মীদেরকে লাঠিচার্জ ও গুলি করেন। এ সময় মকবুল নামে এক বিএনপিকর্মী আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়।

অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোরধী আন্দোলনে ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদকে গুলি করে হত্যার মামলায় সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল হক দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আসামির সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আসামি পক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ রিমান্ডের পক্ষে অবস্থান নেন।

সোমবার রাতে রাজধানীর ইস্কাটন এলাকা থেকে আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই বিকালে নিউমার্কেট থানার নীলক্ষেত এলাকায় পুলিশের গুলিতে ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ মারা যান। এ ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন আব্দুল ওয়াদুদের শ্যালক আব্দুর রহমান। গত ৩ অক্টোবর আব্দুর রাজ্জাক ও তার স্ত্রী ও তিন সন্তানের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়। একই সঙ্গে তাদের ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ব্যাংক হিসাব স্থগিতের এ নির্দেশনা দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মানি লন্ডারিং পরিপালন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়েছে।

টাঙ্গাইল-১ (ধনবাড়ী-মধুপুর) আসনে টানা পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মেয়াদে তিনি খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন। এরপর ২০১৯ সালে চতুর্থ মন্ত্রিসভায় তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিত্ব পাননি। আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে (বিএডিসি) একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন এবং ২০০১ সালে চাকরিজীবন শেষ করেন।

প্রসঙ্গত, জুলাই-আগস্টে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনের তোপের মুখে পড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এমপি-মন্ত্রীসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। ইতিমধ্যে এই সংখ্যা অর্ধশতাধিক ছাড়িয়েছে। 

তারই ধারাবাহিকতায় সোমবার গ্রেপ্তার হলেন সাবেক দুইমন্ত্রী ফারুক খান এবং আব্দুর রাজ্জাক। তারা ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তাদের আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি।