সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ঘনিষ্ঠ বিতর্কিত সংগঠন ‘সাইবার টিনস’ এর প্রতিষ্ঠাতা সাদাত রহমান। পলকের আশীর্বাদে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অন্তত অর্ধ ডজন সুবিধাভোগী সাদাতকে বাদ দিয়ে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরও সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিল সাইবার টিনস তথা সাদাত। বিষয়টি সমালোচনার জন্ম দিলে অবশেষে বাদ দেওয়া হলো সাদাতকে।
আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী জানান, বিগত সরকারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে সাদাতের ঘনিষ্ঠতার বিষয় নিশ্চিত হয়েই তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
দেশজুড়ে কিশোর-কিশোরীদের সাইবার অপরাধ থেকে সুরক্ষা দিতে অথবা অপরাধের শিকার হলে আইনগত সহায়তা প্রদানে কাজ করে আইসিটি বিভাগের অধীন এই কমিটি। জাতীয় পর্যায়ের কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে জেলা শাখাও রয়েছে কমিটির। পদাধিকার বলে আইসিটি বিভাগের উপদেষ্টা এই কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা। আইসিটি বিভাগের সচিব কমিটির সভাপতি এবং আইসিটি বিভাগের আওতাধীন জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক কমিটির সদস্যসচিব। কমিটির সূচনালগ্ন থেকে সাইবার টিনসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এর সদস্য ছিলেন সাদাত রহমান। বিগত ২৮ নভেম্বর পুনর্গঠিত কমিটিতে ৩৯ নম্বরে ‘প্রতিষ্ঠাতা সাইবার টিনস’ হিসেবে ছিলেন তিনি। তবে সর্বশেষ পুনর্গঠিত কমিটি থেকে সাইবার টিনস তথা সাদাতকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
আইসিটি বিভাগের সংস্থা-৩ শাখার উপসচিব আবু নাছের স্বাক্ষরিত কমিটিতে সদস্য তালিকায় সাদাত রহমানকে রাখা হয়নি। গত ২৩ ডিসেম্বর কমিটি পুনরায় গঠন করা হলেও সম্প্রতি এর পূর্ণ তালিকা প্রকাশিত হয়।
সাইবার টিনস তথা সাদাত রহমানের বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে আইসিটি বিভাগ থেকে নানা সুবিধা নিয়েছেন সাদাত। আইসিটি বিভাগের অন্তত তিনটি প্রকল্পকে রীতিমতো ঘোল খাইয়েছিলেন সাদাত। সাইবার টিনসের প্ল্যাটফর্ম ডেভেলপের জন্য ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) বাস্তবায়নধীন ‘আইডিয়া’ প্রকল্প থেকে ৩ লাখ টাকা অনুদান নেন সাদাত। অথচ সেই প্ল্যাটফর্ম আবার অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রকল্প থেকে বিনা মূল্যে করিয়ে নেন তিনি। এটুআই’কে দিয়ে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) থেকে সরকারি ডোমেইন ‘ডট গভ ডট বিডি’ নিবন্ধন করে নেন সাদাত। ডোমেইন ও ওয়েবসাইট সরকারি হলেও দীর্ঘদিন এর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সাদাত রহমান। এমনকি ওয়েবসাইটের কনটেন্টও ছিল সাদাতের নিয়ন্ত্রণে।
শুধু তাই নয়, সাইবার টিনসের পুরোনো ওয়েবসাইট সংযুক্ত করা ছিল সরকারি ডোমেইনের ওয়েবসাইটের সঙ্গে। ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে ‘হোম’ এ ক্লিক করলে ব্যবহারকারী পৌঁছাবেন সরকারি ওয়েবসাইটে। পাশাপাশি ফেসবুকে সাইবার টিনসের পেজেও ওয়েবসাইট হিসেবে সরকারি ওয়েবসাইটটির উল্লেখ ছিল। সাইবার টিনসের প্রাতিষ্ঠানিক এবং সাদাত রহমানের ব্যক্তিগত প্রভাব জাহির করতেই সরকারি ওয়েবসাইট নিয়েছিলেন তিনি।
সম্প্রতি সাইবার টিনস এবং সাদাত রহমানকে নিয়ে বিতর্ক উঠলে ডোমেইন এবং ওয়েবসাইটের নিয়ন্ত্রণ হারান তিনি। আইডিয়া এবং এটুআই প্রকল্পের মাধ্যমে সাদাতকে নানারকম সুবিধা দিতে পলকের মৌখিক নির্দেশনা ছিল বলে প্রকল্পগুলোর তৎকালীন সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে রূপালী বাংলাদেশকে। পরিচয় গোপনের শর্তে আইডিয়া প্রকল্পের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, সাইবার টিনস’কে অনুদান দেওয়ার অগ্রগতি দফায় দফায় জানতে চাইতেন পলক।
আইসিটি বিভাগে সাদাতের সুবিধা নেওয়ার শুরুটা হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। যশোর হাইটেক পার্কে অফিস বরাদ্দ পায় সাইবার টিনস। পরবর্তীতে বাগিয়ে নেন রাজধানীর কাওরান বাজারের ‘ভিশন-২০২১ টাওয়ার-১’ সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে অফিস স্পেস। অবকাঠামো দুটির স্টার্টআপ ফ্লোরে বিনা ভাড়ায় সেই স্পেস বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ সাইবার টিনসকে ‘অলাভজনক প্রতিষ্ঠান’ দাবি করেন সাদাত নিজেই। বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপনের শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সাইবার টিনস’কে স্পেস দিতে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের জোর সুপারিশ ছিল। তাদের থেকে ভাড়া না নিতে পলকের আদেশে স্টার্টআপ ফ্লোরে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
আইসিটি বিভাগের আরেক সংস্থা ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার থেকে টিভি বিজ্ঞাপন প্রস্তুত বাবদ ৫ লাখ টাকা নিয়েছিল সাইবার টিনস। কখনো টিভিতে প্রচারিত হয়নি। রাষ্ট্রীয় অর্থে ২০২২ সালের মে’তে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ‘গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট’ এ পলকের সফরসঙ্গী ছিলেন সাদাত। যে উদ্দেশ্যে তাকে নেওয়া হয় সেই উদ্দেশ্যও পরবর্তীতে আর বাস্তবায়িত হয়নি। অন্যদিকে, পলকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সরকারি চাকরিজীবী বাবা সাখাওয়াত হোসেনকে ঢাকায় বদলি করান সাদাত। বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে সাদাত রহমানের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করলেও, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় নীরব ছিলেন সাদাত। তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে ১৪ মে এরপর থেকে প্রকাশ করা সব পোস্ট সরিয়েছেন। অভ্যুত্থানের পর গত ৮ আগস্ট এক ভিডিও বার্তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ফেরেন সাদাত। সেখানে দাবি করেন, সাইবার টিনস প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় সরাসরি ও প্রকাশ্যে ছাত্রদের পক্ষে কোনো অবস্থান নেননি তিনি। তবে আন্দোলনের সময় সাদাত ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পোস্ট করেছিলেন বলেই সেগুলো সরাতে হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
এত বিতর্কের পর অবশেষে কমিটি থেকে বাদ পড়লেন সাদাত রহমান। এ বিষয়ে আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সাবেক আওয়ামী সরকারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি জানতে পেরেছি। মূলধারার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারসহ লিখিতভাবেও আমাদের বিষয়টি একাধিক সূত্র জানিয়েছে এবং বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়েছি। তারপরেই তাকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
তবে কমিটি থেকে বাদ পড়ে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন সাদাত। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় সহায়তার প্রস্তাব আমরাই দিয়েছিলাম। এখন আমাদেরই সেই কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এজন্য কোনো কারণও জানানো হয়নি। আগামীতে হয়তো আবারও সরকারি সহায়তা পাব কিন্তু এখন বেসরকারিভাবেই কাজ করব।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন