সিএনজি বা পেট্রলচালিত অটোরিকশার চালক মিটারের বেশি ভাড়া আদায় করলে তার বিরুদ্ধে মামলা দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
সড়ক পরিবহন আইন না মানলে ভাড়া সংক্রান্ত অপরাধে চালকের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের সই করা এক চিঠিতে এমন তথ্য জানানো হয়। ওই চিঠিটি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
অবশ্য এমন আইন মানতে নারাজ অটোচালকেরা। তাদের দাবি যানজটের শহরে মিটারে চললে পেটের ভাত জুটবে না।
তবে এসব বিষয় নিয়ে সচেতন মহল বলছেন, সারা দেশে অটোরিকশায় ভাড়ার নৈরাজ্য চলে।
কেউ মিটারে ভাড়া নিতে চান না। যদি তারা মিটারে ভাড়া নিতে না চায়, তাহলে মিটারের কাজটা কী?
সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকেরা বলছেন, রাজধানীতে যারা অটোরিকশায় চলাচল করে থাকেন, তারা নিশ্চয়ই তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন।
আইন অনুযায়ী মিটারেই যাত্রীদের গন্তব্যে যাওয়ার কথা; কিন্তু এই আইন মানা হয় না মোটেও। এ এক অসহনীয় নৈরাজ্য।
যাত্রীরা বলছেন, চুক্তি হয় যাত্রী ও চালকের মধ্যে এবং এ চুক্তি এমন যে, মিটারের ভাড়ার চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের।
গত ২১ বছরেও যেহেতু মিটারের ভাড়া অনুযায়ী গন্তব্যে যাওয়ার আইনটি কার্যকর হয়নি, তাই প্রশ্ন উঠেছে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলতে কি কিছু ছিল না কি নেই?
সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চালকদের সৃষ্ট নৈরাজ্য প্রতিরোধে ট্রাফিক বিভাগের তৎপরতাও চোখে পড়ে কম। যদিও তারা বলছে, এ নৈরাজ্য বন্ধে তাদের আন্তরিকতার অভাব নেই।
সূত্র জানায়, রাজধানীতে মাত্র দুই শতাংশ অটোরিকশাচালক মিটারে যেতে রাজি হয়, তা-ও আবার ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া বা ‘বকশিশ’ দাবি করা হয়।
দ্বিতীয়ত, যাত্রীদের ইচ্ছামতো গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না ৮৮ শতাংশ অটোরিকশাচালক।
চুক্তিতে চলাচলকারী অটোরিকশাচালক সর্বনিম্ন ৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৭১০ দশমিক ৮১ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন মিটারের ভাড়ার চেয়ে।
সব মিলিয়ে অটোরিকশা খাতে চলে মহানৈরাজ্য। তবে এসব বিষয়ে পুলিশ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে শক্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, এর আগে ২০০৮ সালের সড়ক আইনে অটোরিকশা মিটারবিহীন চললে চালককে ছয় মাসের জেল এবং মালিককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল।
এ আইনের প্রয়োগ প্রসঙ্গে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেছেন, যেকোনো সরকার চাইলে এক সপ্তাহের মধ্যে অটোরিকশার ভাড়ানৈরাজ্য বন্ধ করে এ খাতকে সুশৃঙ্খল করা সম্ভব। আমরা তার এ কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করি।
অটোরিকশা খাতের নৈরাজ্য বন্ধ করতে হলে প্রথমে দরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
ঢাকা প্রতিদিন সিএনজিতে চলাচলরত কাদের খাঁ বলেন, অটোরিকশাচালকরা একটা সংঘবদ্ধ অপশক্তি হিসেবে যাত্রীদের জিম্মি করে তাদের ‘গলা কাটবেন’ এ নৈরাজ্য মেনে নেওয়া যায় না।
আরেক যাত্রী মামুন শেখ জানান, ২০০৮ সালের পর যাত্রীভাড়া পাঁচবার বাড়ানো হয়েছে।
এই সুবিধা দেওয়ার পরও অটোরিকশার চালকরা সন্তুষ্ট নন! সড়ক আইন অনুযায়ী, চুক্তিতে চলাচলকারী অটোরিকশার বিরুদ্ধে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। অথচ আমরা এ আদালতের তেমন তৎপরতা লক্ষ করিনি।
সিএনজি-পেট্রলচালিত-অটোরিকশার চালক বেশি ভাড়া আদায় করলেই মামলা: এদিকে সিএনজি বা পেট্রলচালিত অটোরিকশার চালক মিটারের বেশি ভাড়া আদায় করলে তার বিরুদ্ধে মামলা দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
সম্প্রতি তাদের একটি চিঠিতে পুলিশকে বলা হয়, গ্যাস বা পেট্রলচালিত ফোর-স্ট্রোক থ্রি-হুইলার অটোরিকশার জন্য সরকার নির্ধারিত মিটারের ভাড়ার হারের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে মামলা রুজু করার নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এতে আরও বলা হয়েছে, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ধারা ৩৫(৩) অনুযায়ী কোনো কন্ট্রাক্ট ক্যারিজের মালিক বা চালক রুট পারমিট এলাকার মধ্যে যেকোনো গন্তব্যে যেতে বাধ্য থাকবেন এবং মিটারে প্রদর্শিত ভাড়ার অতিরিক্ত অর্থ দাবি বা আদায় করতে পারবেন না।
এর ব্যত্যয় হলে আইনের ধারা ৮১ অনুযায়ী অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কর্তন করার বিধান রয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে অটোরিকশার মালিকের জন্য দৈনিক জমা নির্ধারিত আছে ৯০০ টাকা।
তবে চালকেরা বলছেন, মালিকেরা দিনে দুই বেলায় চালকের কাছে অটোরিকশা ভাড়া দিয়ে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন। যার কারণে মিটারে চললে তাদের সংসার চালাতে কষ্ট হয়ে উঠবে বলে জানান তারা।
অটোরিকশার চালক শহিদুল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, মিটারে না চললে অটোরিকশাচালকের জরিমানা ৫০ হাজার টাকার এই আইন বাস্তবায়নের আগে সরকারকে আমাদের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন একটা সিস্টেমে চলছি। আমরা এই শহরে সময়মতো যানজটের কারণে গন্তব্যে যেতে পারি না। এ জন্য হয়তো একটু বেশি ভাড়া আদায় করতে হয়।
কিন্তু যদি মিটারে চলতে হয় তাহলে তো আমাদের অটো চালানো ছেড়ে দিতে হবে।
প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ১২ টাকা নির্ধারিত থাকলেও তা কেউ মানেন না:
সূত্র জানায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী প্রায় ২৮ হাজার অটোরিকশার জন্য পৃথক নীতিমালা রয়েছে।
এসব অটোরিকশাকে কন্ট্রাক্ট ক্যারিজ বা ভাড়ায় চালিত যান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নীতিমালা অনুসারে, সিএনজি ও পেট্রলচালিত অটোরিকশার ভাড়া ও মালিকের দৈনিক ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা জমা নির্ধারিত রয়েছে।
অটোরিকশার বর্তমান সর্বনিম্ন (প্রথম দুই কিলোমিটার) ভাড়া ৪০ টাকা; অর্থাৎ একজন যাত্রী চাইলে ৪০ টাকায় অটোরিকশা ভাড়া করার সুযোগ পাবেন।
যাত্রীদের অভিযোগ, ১৫০ টাকার নিচে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াত করা যায় না। দুই কিলোমিটারের পরের প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা নির্ধারিত থাকলেও তা কেউ মানেন না।
নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে চাইলে অনেক ক্ষেত্রেই চালকেরা অনীহা দেখান: ২০০৩ সালের দিকে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে বেবি ট্যাক্সি তুলে দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালু করে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার।
মিটারে নির্ধারিত ভাড়া ও যাত্রীদের চাহিদামতো গন্তব্যে চলাচল করতে বাধ্য থাকবে এই ছিল মূল শর্ত।
কিন্তু নগরবাসী বলছেন, কখনোই শর্তগুলো মানা হয়নি। ভাড়া নির্ধারিত হয় চালকের ইচ্ছামতো।
নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে চাইলে অনেক ক্ষেত্রেই চালকেরা অনীহা দেখান।
রাজধানীতে যাত্রীদের রীতিমতো জিম্মি করে রেখেছেন অটোরিকশাচালকেরা: রাজধানীতে যাত্রীদের রীতিমতো জিম্মি করে রেখেছেন অটোরিকশাচালকেরা এমন অভিযোগ করে একাধিক যাত্রী জানান, আটোচালকেরা গন্তব্য পছন্দ না হলে যাত্রী তোলেন না।
যাত্রী তুললেও মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় নয়, চুক্তিতে বেশি টাকায়।
ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা মিটারে চলবে এটা এখন আর কেউ চিন্তাও করে না। কথাটি বলছিলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ মিয়া।
ইকবাল আহমেদ মিয়া বলেন, ‘সর্বশেষ কবে অটোরিকশাচালক মিটারে যেতে রাজি হয়েছেন, মনে নেই। প্রতিবার অটোরিকশায় চড়লে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে।’
যাত্রীর ইচ্ছামতো গন্তব্যে মিটার অনুযায়ী অটোরিকশা চলাচল করবে, এটাই আইন। অথচ রাজধানীতে যাত্রীদের রীতিমতো জিম্মি করে রেখেছেন চালকেরা।
তাদের গন্তব্য পছন্দ না হলে যাত্রী তুলছেন না। যাত্রী তুললেও মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় নয়, চুক্তিতে বেশি টাকায়।
এই নৈরাজ্য দমনে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কোনো তৎপরতা নেই। এ কারণে হয়রানির এই চক্র থেকে যাত্রীদের মুক্তি মিলছে না।
কী বলছেন চালক ও যাত্রীরা: রাজধানীর কলেজগেটে জাতীয় হৃদ্রোগ হাসপাতালে রোগী দেখতে এসেছিলেন মিরান হোসেন। সেখানে থেকে মিরপুর ১০ নম্বর যাওয়ার জন্য অটোরিকশাচালক ভাড়া চান ২৫০ টাকা।
শেষে ২০০ টাকায় যেতে রাজি হন চালক। অথচ সরকার নির্ধারিত হিসাবে ২৫ মিনিট যানজটসহ এই দূরত্বের ভাড়া আসে ১২০ টাকা।
মিরান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, একসময় অটোরিকশাচালকেরা মিটারে যা ভাড়া আসত, তার চেয়ে ২০ টাকা বেশি চাইতেন। কিন্তু এখন আর কেউ মিটারের কথা বলেন না।
নিজেদের মতো একটা ভাড়া চান। মিটারে গেলে হয়তো এর অর্ধেকের কাছাকাছি খরচ হতো। এখন আর এসব নিয়ে কেউ কথা বলে কি না আমার জানা নেই।
কয়েকজন চালক অভিযোগ করেন, সরকার নির্ধারিত অটোরিকশার জমা ৯০০ টাকা। কিন্তু মালিক ১ হাজার টাকা আবার অনেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত জমা নেন।
সকাল ৯টায় একটি অটোরিকশা নিয়ে বের হলে জমা তুলতে বিকেল ৪টা থেকে ৫টা বেজে যায়।
তার ওপর গ্যাস ও দিনের খাবার খরচ আছে। এসবের পর একজন চালকের নিজের জন্য টাকা থাকে খুব সামান্য।
অটোরিকশাচালক মিরাজ মিয়া বলেন, দিনের একটা বড় সময় চলে যায় যানজটে। জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।
গ্যাস খরচ আছে। মিটারে চালালে দিনশেষে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি থাকে না। বাধ্য হয়েই চুক্তিতে চালাতে হয়।
প্রাইভেট অটোরিকশার চালক আজগর মিয়া বলেন, ‘ঢাকায় এখন প্রাইভেট কি আর বাণিজ্যিক কি সব অটোই ভাড়ায় চলে।
প্রাইভেট অটোরিকশা ভাড়ায় চলে, এটা সবাই জানে। ট্রাফিক পুলিশদের ম্যানেজ করেই প্রাইভেট অটো চলে। ভেতরে মালিক আছে নাকি যাত্রী, কেউ তাকায়ও না।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক শীর্ষ কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, মানুষের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা কম। ৫ আগস্টের পর অনেকেই পুলিশকে মানতে চাইছেন না।
তবে আমরা জনকল্যাণে কঠোর হচ্ছি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে শক্ত হচ্ছি।
তিনি বলেন, তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সিএনজি বলেন আর অটোরিকশা বলেন এ ক্ষেত্রে নৈরাজ্য বন্ধ করতে হলে শুধু পুলিশ দিয়ে হবে না, সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন