দুপুর ১টা, গণপরিবহন না পেয়ে চৈত্রের রোদে রাস্তার ধার ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছেন মাইনুল ইসলাম। উদ্দেশ্য বিজয় সরণি থেকে ফার্মগেট। হঠাৎ ঘটল বিপত্তি, উল্টোপথে নভোথিয়েটার থেকে আসা ব্যাটারিচালিত রিকশা ধাক্কা দিয়ে হিঁচড়ে নিল ৪ থেকে ৬ ফুট।
মাইনুল ইসলাম ধমক দিয়ে বললেন, ‘আস্তে মামা এখন তো থামা! পায়ের চামড়া উঠে গেছে চোখে দেখ না? বাপ-দাদাই প্লেন চালাই তো আপনে চালান ব্যাটারি! খালি রাস্তায় মেরে দিচ্ছ, সব কি মগের মুল্লুক!’ মুহূতের্ই ট্যাফিক পুলিশ ও উৎসুক জনতা ঘিরে ধরল।
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গ্রামে যাওয়া কর্মব্যস্ত মানুষগুলো আবার ঢাকায় ফিরতে শুরু করলেও যে পরিমাণ মানুষ ঢাকা ছেড়েছে এখনো সবাই ফেরেননি। সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকায় যারা ঢাকায় ফিরেছেন, তারা বাইরে খুব একটা বের হচ্ছেন না।
ফলে রাজধানী ঢাকার রাস্তাগুলো এখনো প্রায়ই ফাঁকা। এই ফাঁকা সড়কে রিকশা-বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দাপটে রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নগরবাসী। বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা।
প্রধান সড়ক এমনকি ফ্লাইওভারগুলোতেও ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল করছে। তুলনামূলক কম ভাড়া এবং দ্রুতগতির কারণে অটোরিকশাকে বেছে নিচ্ছেন নগরবাসী। অন্যদিকে, তিন চাকার এই বাহনটির বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনাও ঘটছে হরহামেশাই।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে দেখা যায়, অনিয়ন্ত্রিতভাবে অটো ও ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে অলিগলিতে চলাচল করলেও ফাঁকা ঢাকায় এসব রিকশাচালকেরা সড়ক-মহাসড়ক এমনকি ফ্লাইওভারের ওপরেও নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে।
অপ্রশিক্ষিত এসব অটোচালকের ভুলে বিঘ্ন হচ্ছে সড়কে মানুষের বা অন্যান্য বাহনের স্বাভাবিক চলাচল। কোনোরকম নিয়মশৃঙ্খলা না মেনে খেয়াল-খুশিমতো মুহূর্তে তারা সড়কের এপাশ-ওপাশ করে যাত্রী পারাপার করছে।
ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা জানান, এসব চালকের লাইসেন্স বা বৈধ ডকুমেন্টস না থাকায় তাদের আটকাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। একইসঙ্গে ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে যারা রয়েছেন তারা বিভিন্ন স্থানে চলাচল করতে ব্যাটারি রিকশা ব্যবহার করছেন।
ফলে অনেকটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের থামানো হচ্ছে না। তবে, উল্টোপথ এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কে উঠতে বাধা দিয়েও আটকাতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।
বেসরকারি কর্মকর্তা সুমন নাছির রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ঈদের এই ছুটিতে যানবাহন সংকটসহ নানা অজুহাতে ঢাকাজুড়ে এসব অটো ও ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বেড়েছে।
তাদের বেপরোয়া গতি এবং ট্রাফিক রুল না মানায় রাজধানীজুড়ে হতাহত বেড়েছে অনেক বেশি। দেখা যাচ্ছে, যারা অটোচালক তাদের বেশির ভাগই অপ্রাপ্তবয়স্ক বা বৃদ্ধ বয়সের।
যাদের পক্ষে গতিসম্পন্ন বাহনকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, যার জন্য যখন তখন ঘটছে মারাত্মক দুর্ঘটনা। আমি নিজে এই বাহনটি ব্যবহার করি না। সবাইকেই সচেতন হওয়া উচিত।
এদিকে, ঈদের চারদিনের ছুটিতে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৪২ জন নিহত এবং প্রায় ৭০ জন আহত হয়েছেন। গত রোববার থেকে বুধবার পর্যন্ত এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটে।
নিহতদের মধ্যে চট্টগ্রামে ১৫, গাজীপুরে ৬, মাদারীপুর ও ময়মনসিংহে ৪ জন করে, কুমিল্লা ও বগুড়ায় ৩ জন করে, কুষ্টিয়া ও রংপুরে ২ জন করে এবং ঢাকা, শেরপুর ও নওগাঁয় ১ জন করে রয়েছেন।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগের তথ্যমতে, ঈদের আগে-পরে ৫ দিনে অটোরিকশার কারণে ৫০টির বেশি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক।
এ অবস্থায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নগরবাসীকেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। একইসাথে, অটোরিকশার অবাধ চলাচল ঠেকাতে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিজয় সরণিতে কথা হয় অটোচালক শফি মন্ডলের সঙ্গে। তিনি অটোরিকশার উচ্চ গতি এবং সড়কে যেখানে সেখানে যাত্রি তোলা নামানোর ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে শিকার করে বলেন, অনেক সময় নষ্ট গাড়ির ফেলে দেওয়া বা ব্যবহারের অনুপযুক্ত যন্ত্রপাতি ও পুরাতন ব্যাটারি দিয়ে কোনোমতে তৈরি করা এসব রিকশা। ফলে আমরা কম দামে পেলেও যাত্রীর নিরাপত্তার জন্য এবং আমাদের জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হয়।
তথ্য পাওয়া যায়, অটোরিকশা বা ইজিবাইকের ব্যবহৃত ব্যাটারিগুলো চার্জনির্ভর হওয়ার ফলে প্রতিদিন একাধিকবার এর ব্যাটারি চার্জ করতে হয়। ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার জন্য অবৈধভাবে কয়েক হাজার গ্যারেজ গড়ে তোলা হয়েছে। এসব অবৈধ লাইনে ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে অপচয় হচ্ছে বিদ্যুৎ।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক পুলিশ সার্জেন্ট বলেন, এক্ষেত্রে যাত্রীদের সচেতনতার বিকল্প নেই। যারা অটোরিকশায় চড়বেন সতর্কতার সঙ্গে চড়া উচিত। চালককে উদ্বুদ্ধ উচিত করা আস্তে চলাচলে। যেসব রাস্তায় এগুলো চলাচল নিষিদ্ধ সেসব রাস্তায় যাত্রীরা যেন ব্যবহার না করেন। তবেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুল নেওয়াজ জানান, থ্রি হুইলার ও ব্যাটারিচালিত রিকশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রাজধানীসহ দেশে দুর্ঘটনা কমনো যাবে না।
এই গাড়িগুলো যারা চালাচ্ছে তারা যেমন অনিরাপদ তেমনি এই গাড়িগুলোও অনিরাপদ। ব্রেক করতে পারে না ডানে বামে চলে আসে। নির্দিষ্ট রাস্তা ছেড়ে মেইন রাস্তায় যেন উঠে আসতে না পারে সে ব্যাপারে স্ট্রংলি মনিটর করা উচিত।
ডিসি (মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স) ডিএমপি, মুহাম্মদ তালেবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ঈদে গণপরিবহন কম থাকায় যাত্রীরা বিকল্প হিসেবে অটোরিকশায় চলাচল করছে। তবে মূল সড়কে যেন অটোরিকশা উঠতে না পারে, এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের মাধ্যমে।
এছাড়া সড়ক অটোরিকশামুক্ত করতে অভিযান চলমান রয়েছে। পাশাপাশি দ্রুতগতির এই বাহনটি রাজধানীর সড়ক থেকে সরাতে যাত্রীদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, যারা অটোরিকশায় চড়বেন, তাদের অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। চালককে উদ্বুদ্ধ করবেন ধীরেসুস্থে চালাতে। যেসব রাস্তায় এগুলো চলাচল নিষিদ্ধ, সেসব রাস্তা যাত্রীরা যেন ব্যবহার না করেন।
 

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
       -20251031164129.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন