শুক্রবার, ০৯ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রহিম শেখ

প্রকাশিত: মে ৮, ২০২৫, ০৫:০০ এএম

ব্যাংকের চেয়ারম্যান করেন এমডির কাজ!

রহিম শেখ

প্রকাশিত: মে ৮, ২০২৫, ০৫:০০ এএম

ব্যাংকের চেয়ারম্যান করেন এমডির কাজ!

মেহমুদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

বেসরকারি খাতের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কমার্স (আইএফআইসি) ব্যাংক থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সালমান এফ রহমান সিন্ডিকেট সরিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংক শিকদার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকাকালে এমডি মেহমুদ হোসেনকে হঠাৎ করেই আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি সারা দেশে ব্যাংকটির শাখা-উপশাখা পর্যায়ে অনলাইনে একটি সভা করে প্রতিটি শাখায় তার বাণী ও ছবি টাঙানোর নির্দেশনা দেন। এরপর তিনি ব্যাংকিং আইন ভঙ্গ করে আইএফআইসির বড় ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের নানা ধরনের সুবিধা দিতে আলোচনায় বসেন। এরপর ব্যাংকের কর্মী নিয়োগ ও পদোন্নতিসহ অনেক বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কারণে আইএফআইসি ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের। ব্যাংকের এমডি থেকে সরাসরি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় মেহমুদ হোসেনকে নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠছে। 

অভিযোগ উঠছে, শাখা ব্যবস্থাপকদের নিয়মিত দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান এবং হুমকি প্রদান করছেন তিনি। এ ছাড়া ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন মেহমুদ হোসেন। একই সঙ্গে ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে ঋণ মঞ্জুর করারও অভিযোগ উঠছে তার বিরুদ্ধে। 

জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের দখলে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বেসরকারি এ ব্যাংকের পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ হারান সালমান ও তার ছেলে আহমেদ শায়ান এফ রহমান। ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে গত বছরের ১৩ আগস্ট আহমেদ শায়ানের পরিচালক হওয়ার প্রস্তাবে আপত্তি দিয়ে ব্যাংকটিকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৫ সাল থেকে এফ রহমান ছিলেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান। 

এর আগে, ২০১০ সালে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর শায়ান ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক এমডি মো. মেহমুদ হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবতাদুল ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ জহির ও সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ কাজী মো. মাহবুব কাশেমকে ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যাংকে সরকারের ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ শেয়ার থাকায় অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফা ও যুগ্ম সচিব মুহাম্মদ মনজুরুল হককে প্রতিনিধি পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরমধ্যে ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান মো. মেহমুদ হোসেন দায়িত্ব নিয়েই ব্যাংকটির স্বাভাবিক পরিচালনা কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ শুরু করেন। ব্যাংকটিতে স্বেচ্ছাচারিতা কায়েম করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি আইএফআইসি ব্যাংকের সব শাখায় চেয়ারম্যানের বাণী ও ছবি টাঙাতে হবে বলে বিশেষ নির্দেশনা জারি করেন। ব্যাংকের কমিউনিকেশন অ্যান্ড ব্র্যান্ডিং বিভাগ থেকে সব শাখার ম্যানেজারদের এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা ও বাণী মেইল করা হয়, যা সরাসরি ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন।

আইএফআইসি ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লিখিতভাবে যে চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনুসরের কাছে দিয়েছেন তাতে বলা হয়, চেয়ারম্যান নিয়মিত ১০টা-৫টা অফিস করার সময় শীর্ষ ম্যানেজমেন্টকে বারবার ডেকে পাঠান এবং তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করেন। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পর্ষদ কর্তৃক গঠিত কোনো কমিটির চেয়ারম্যান বা কোনো পরিচালক একক বা ব্যক্তিগতভাবে কোনো নীতিনির্ধারণী বা নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ, ব্যাংকের প্রশাসনিক বা পরিচালনাগত দৈনন্দিন কাজে অংশগ্রহণ বা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। কিন্তু তিনি দেশের সব ম্যানেজমেন্ট কর্মকর্তার সঙ্গে অনলাইনে মিটিং করেছেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি প্রজ্ঞাপন নং-৪৩ এর পরিপন্থি। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ও হাইব্রিড পদ্ধতিতে সভা আয়োজন করা যাবে না।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রমোশন স্থগিত ও চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে তিনি ইঙ্গিত প্রদান করেন, যা ব্যাংকের সব কর্মকর্তার মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কর্মকর্তারা মারাত্মকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এখন থেকে সব প্রমোশন ও ট্রান্সফার বোর্ড দেখবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। 

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আইএফআইসি ব্যাংকে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, যা ব্যাংকটির কাজে গতি ফেরাতে বাধা সৃষ্টি করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, একজন চেয়ারম্যান ম্যানেজমেন্টের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। যদি করে থাকেন তাহলে নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। আবার গ্রাহক ডিল করাও তার কাজ নয়। তিনি ম্যানেজমেন্টকে পলিসি বা টার্গেট দিতে পারেন। তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব ম্যানেজমেন্টের।

 এসব বিষয়ে জানতে আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মেহমুদ হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস এবং ই-মেইল করলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

 তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকের এক পরিচালক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যান আগে একাধিক বেসরকারি ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। সেই জায়গা থেকে ব্যাংকটি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে শুরুর দিকে চেয়ারম্যানের কিছু কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এখন আর সমস্যা নেই বলে তিনি জানান।

রূপালী বাংলাদেশ কথা বলেছে ব্যাংকের বেশ কয়েকজন ঋণগ্রহীতার সঙ্গে। তাদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যান ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে ঋণ মঞ্জুর করেছেন। তারা বলছেন, শাখা পর্যায়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের নির্দেশে ঋণ পুনঃতপশিলের আবেদন করা হলেও চেয়ারম্যান তা আটকে দিচ্ছেন। অর্থাৎ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের নির্দেশ ছাড়া কোনো নোটও বোর্ডে উপস্থাপন করতে পারছেন না ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ঋণগ্রহীতারা চেয়ারম্যানকে মাসের পর মাস ফোন দিলেও তিনি ধরেন না।
  
এস আলম ও শিকদার গ্রুপের ব্যাংকের নেতৃত্বে ছিলেন মেহমুদ হোসেন

ব্যাংকিং ক্যারিয়ারেও মো. মেহমুদ হোসেনের রেকর্ড খুব উজ্জ্বল নয়। বরং বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে তার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। যেমন প্রাইম ব্যাংক থেকে ব্যাংক এশিয়ায় এমডি হিসেবে আসার পর প্রাইম ব্যাংকের মেরিনা এশিয়া, এটলাস গ্রীনপেক, স্ক্যানডেক্স, এমারেল্ড অয়েল ও ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ঋণ টেকওভার করেছিলেন মেহমুদ হোসেন। এসব ঋণ টেকওভারে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় ব্যাংক এশিয়ার বোর্ড তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছিল।

 নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইএফআইসি ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, মেহমুদ হোসেন বিভিন্ন ব্যাংকে এমডির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই এখনো এমডির মতো কাজ করতে চাচ্ছেন। এখানে তো তিনি চেয়ারম্যান। তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত নন। তার চেয়ারম্যান হিসেবেই কাজ করা উচিত। 

লন্ডনে পরিচালনা পর্ষদের ভ্রমণ বিলাস

আইএফআইসি ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আইএফআইসি মানি ট্রান্সফার (ইউকে) লিমিটেড। দীর্ঘদিন ধরে লোকসানের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। 

তথ্য মতে, গত বছর ৯ মাসে এক্সচেঞ্জ হাউসটি বাংলাদেশি মুদ্রায় লোকসান করেছে মোট আড়াই কোটি টাকার বেশি। অথচ এই লোকসানি এক্সচেঞ্জ হাউস দেখার নামে লন্ডনে আট দিনের বিলাস ভ্রমণ করে আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড। লন্ডনে যাওয়া-আসা ও থাকাকালে আট দিনের জন্য প্রায় ৬৬ লাখ টাকা ব্যয় করেছে আইএফআইসির পরিচালনা বোর্ড। ব্যাংকের অর্থে বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করেন আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পাঁচ পরিচালক ও কোম্পানি সচিব; যদিও চেয়ারম্যানসহ চার পরিচালকই ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার নন।

 জানতে চাইলে ব্যাংকটির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ইউকে সরকারের রেগুলেশন অনুযায়ী, ‘মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন’ শীর্ষক একটি ট্রেনিংয়ে উপস্থিত থাকতেই গত ২১ ফেব্রæয়ারি মূলত বতর্মান বোর্ড যুক্তরাজ্য গমন করে। আর এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলে সেখানে আমাদের ব্যবসা বন্ধ করেও দিতে পারেন এই শঙ্কাও ছিল। 

তিনি আরও বলেন, আইএফআইসি মানি ট্রান্সফার (ইউকে) লিমিটেডের ২০২৪ সালের ব্যালান্স শিট এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। ব্যালান্স শিট তৈরির জন্যই মূলত পরিচালকরা যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন। তাই প্রতিষ্ঠানটি লাভে নাকি লোকসানে আছে, তা আগে থেকেই বলা যাচ্ছে না। যেমন ২০২৩ সালে মানি ট্রান্সফারের (ইউকে) প্রায় সাড়ে ছয় লাখ পাউন্ড লাভ হয়েছে। এদিকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের লন্ডন ভ্রমণের বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ১৭ ফেব্রæয়ারি এ-সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করা হয়। ইউকে সরকারের রেগুলেশন অনুযায়ী ‘মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন’ শীর্ষক ওই ট্রেনিংয়ে উপস্থিত থাকার যুক্তি তুলে ধরে ব্যাখ্যা দেয় আইএফআইসি ব্যাংক।

Link copied!