বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব নিয়ে নাটকীয়তা যেন পিছু ছাড়ছে না। সম্প্রতি নাজমুল হোসেন শান্তর টেস্ট অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই নাটকীয়তা আরও জোরালো হলো।
জানা গেছে, ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকে তাকে আকস্মিকভাবে এবং ‘অপমানজনকভাবে’ সরিয়ে দেওয়াই এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক যুগের বেশি সময় ধরে ছিল নাজমুল হাসান পাপনের রাজত্ব। তার আমলে একাদশ গঠন, অধিনায়ক বেছে নেওয়া থেকে সবকিছুই হতো নাটকীয়ভাবে। পাপন যুগের পর দায়িত্বে এলেন ফারুক আহমেদ, তার সময়ে একের পর এক নাটক ও সমালোচনা।
নাটকীয়ভাবেই বিসিবি সভাপতির চেয়ার থেকে ফারুক আহমেদের বিদায়ের পর সভাপতির চেয়ারে বসেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আমিনুল যুগে এসেও সেই পুরোনো রোগে আক্রান্ত বাংলার ক্রিকেট। নাটক যেন পিছু ছাড়ছে না বিসিবির।
যোগাযোগ না করে, না জানিয়ে শান্তকে সরিয়ে বিসিবি ওডিআইয়ের দায়িত্ব তুলে দেন মিরাজের কাঁধে। এখান থেকেই শুরু হয় নানা আলোচনা ও সমালোচনা।
গতকাল শনিবার কলম্বোতে এক সংবাদ সম্মেলনে শান্ত ঘোষণা দেন, আমি বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি। আমি টেস্ট সংস্করণে আর এই দায়িত্ব পালন করতে চাই না।
আমি সবাইকে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, এটা ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নয়। পুরোপুরি দলের ভালোর জন্য আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আমি মনে করি, এটাতে দলের ভালো কিছুই হবে।
শান্ত আরও বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, তিনজন অধিনায়ক দলের জন্য সমস্যা হতে পারে। দলের ভালোর জন্য এখান থেকে সরে আসছি। যদি ক্রিকেট বোর্ড মনে করে, তিনটি অধিনায়কই রাখবে, এটা তাদের সিদ্ধান্ত।
ফিরে দেখা ঘটনার ঘনঘটা
শ্রীলঙ্কা সফরের টেস্ট দলের প্রথম ১০ জনের ফ্লাইট নির্ধারিত ছিল, যেখানে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তরও টিকিট কাটা ছিল। কিন্তু গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন বলে তিনি পরের দিনের ফ্লাইট বেছে নেন।
সফরের আগে আয়োজিত সিরিজ-পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে শান্ত হাজির হন। এর কিছুদিন আগেই বিসিবি তার টেস্ট অধিনায়কত্ব এক বছরের জন্য নবায়ন করেছিল, যা নিয়ে তিনি বেশ খুশি ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেকটা খেলোয়াড় যদি লম্বা সময় পায়, তাহলে ভালো। এর আগেও একবার আমি লম্বা সময় পেয়েছিলাম। আবার এক বছরের জন্য দেওয়া হয়েছে।
যে-ই অধিনায়ক থাকবে, তাকে যদি লম্বা সময় দেওয়া হয়, তাহলে অধিনায়কের জন্য কাজটা সহজ হয়। বোর্ডের সঙ্গে যেভাবে কথা হয়েছে, তাতে খুশি।
কথা প্রসঙ্গে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে অধিনায়কত্বের বিষয়টিও উঠে আসে। গত বছর টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব তিনি নিজ থেকেই ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কারণ ব্যাখ্যা করে শান্ত বলেন, টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব ছাড়াটা... আমি নিজ থেকে বোর্ডকে জানিয়েছি আমি করতে চাচ্ছি না। আমার নিজের ব্যাটিংয়ে সময় দিতে চাচ্ছিলাম।
আমাদের এত খেলা হচ্ছে– টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি... ব্যাটিং নিয়ে কাজ করার সুযোগ কম ছিল। নিজের ব্যাটিংয়ে ফোকাস করার জন্যই টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিয়েছি।
সর্বশেষ আসে ওয়ানডে অধিনায়কত্বের প্রসঙ্গ। যেখানে শান্তর অবস্থান খুব একটা ভালো ছিল না এবং তার পায়ের নিচের মাটিও শক্ত ছিল না। তিনি বলতে বাধ্য হন, এখনো জানায়নি, জানাবে ইনশাআল্লাহ।
শান্ত সংবাদ সম্মেলন শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই গুঞ্জন ছড়াতে থাকে যে, ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং মেহেদী হাসান মিরাজকে এর মধ্যেই বিসিবি বেছে নিয়েছে।
শান্ত স্টেডিয়াম পাড়া ত্যাগ করার আগেই নিশ্চিত হয়ে যান যে, ওয়ানডে অধিনায়কত্ব তার কাছে নেই। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, শ্রীলঙ্কায় টেস্ট সিরিজের পরপরই তিনি টেস্ট অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেবেন।
এক বছরের জন্য টেস্ট অধিনায়কত্ব পেয়েও মাত্র এক সিরিজেই তার মেয়াদ শেষ হলো।
বোর্ডের বক্তব্য ও নেপথ্যের কথা
বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম অবশ্য বলেছেন, শান্তর অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়া হয়নি, বরং এটি ছিল বোর্ডের সমন্বিত সিদ্ধান্ত।
তিনি জানান, এখন আমরা প্রতিটি ফরম্যাটে ভিন্ন অধিনায়ক চাই। লিটন টি-টোয়েন্টিতে, শান্ত টেস্টে, মিরাজ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন—এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই পরিবর্তন।
বোর্ডের একজন প্রতিনিধি শান্তকে বিষয়টি জানান এবং তিনি ভালোভাবে নিয়েছেন বলেও দাবি করেন আমিনুল ইসলাম।
তবে, অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, শান্তর সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই বোর্ড তাকে ৫০ ওভারের ফরম্যাট থেকে সরিয়ে দিয়েছে, যা তিনি মোটেও ভালোভাবে নেননি।
শুধু তা-ই নয়, পরবর্তীতে যেভাবে পুরো প্রক্রিয়া বোর্ডের তরফ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সেখানেও চূড়ান্ত গলদ ছিল। এই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত মূলত ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকে ‘অপমানজনকভাবে’ সরিয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়াই।
সেই সঙ্গে বোর্ডের স্বচ্ছতা ও ক্রিকেটারদের সঙ্গে বোর্ডের যোগাযোগ প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে প্রশ্নও উঠছে।
শান্ত ১৪ টেস্টে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যা দেশের হয়ে পঞ্চম সর্বোচ্চ। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ চারটি জয় পেয়েছে এবং জয়ের সাফল্যে তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা টেস্ট অধিনায়ক।
আপাতত পরবর্তী টেস্ট অধিনায়ক কে হচ্ছেন, সে আলোচনা থেমে যাবে। কারণ, বছরের শেষ দিকে নভেম্বরের আগে বাংলাদেশের কোনো টেস্ট নেই। আয়ারল্যান্ড সিরিজের আগে বিসিবি পরবর্তী টেস্ট অধিনায়ক বেছে নেবে।