শাহিন আহমেদ (৩৮) তার আপন ভাই আলফেশানি আহমেদের সর্বশেষ একটি কথা স্মরণ করে বলছিলেন, ‘এটি ছিল একটি গুলির শব্দ। চিৎকারের মধ্যে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা।’ গত ৬ অক্টোবর রাত ৯টা নাগাদ স্মার্টফোন ও ইলেকট্রনিক এক্সেসরিজের দোকানের মালিক ৩৬ বছর বয়সী আলফেশানি তড়িঘড়ি করে কদমতলা বাজারে তার দোকান বন্ধ করে দেন।
এরপর উত্তর-পূর্ব ভারতের উত্তর ত্রিপুরার তিন কিলোমিটার (প্রায় ২ মাইল) দূরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রাম ঝেরঝেরিতে ফিরে যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে পড়েন। সেই সময় জনতা বাজারে দাঙ্গা চালাচ্ছিল।
আলফেশানি জানতেন, তার দোকানটিও রেহাই পাবে না। তাই তিনি দোকান থেকে বের হওয়ার সময় শুধু অ্যাকাউন্ট লেজার নিয়ে যান, যাতে তার সব আর্থিক লেনদেন ও তথ্য রেকর্ড রয়েছে। তবে তার আর প্রাণ নিয়ে ফেরা হয়নি।
হিন্দুদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজার জন্য স্থানীয় একটি হিন্দু ক্লাবের চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ক্লাবের সদস্যরা মুসলিম গাড়িচালক থেকে শুরু করে চাঁদার জন্য যাত্রীকেও লাঞ্ছিত করে।
কদমতলা মহকুমায় হিন্দু ও মুসলমানদের মিশ্র জনসংখ্যা রয়েছে, যার মধ্যে হিন্দুরা জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশেরও বেশি এবং মুসলমানরা প্রায় ৩৫ শতাংশ। রাজ্যের বৃহত্তম `সংখ্যালঘু` গোষ্ঠী মুসলিমরা ত্রিপুরার ৩৬ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর ত্রিপুরার কদমতলা এবং সংলগ্ন অঞ্চলের মুসলমানরা ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতির চিহ্ন হিসাবে দুর্গাপূজা উদযাপনের চাঁদা প্রদান করে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা এর আগে দুর্গাপুজার চাঁদা দাবি না করার জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সতর্ক করেছিলেন।
৬ অক্টোবর সন্ধ্যা নাগাদ পরিস্থিতি বদলে যায়। কারণ হিন্দু ও মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। ফলে সেখানে প্রচুর নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং গুলি চালায়। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে ১৭ জন আহত হন। তবে সেখানে একজন মারা যায়। তিনি ছিলেন আলফেশানি।
আলফেশানির ভাই শাহিন আহমেদ আল জাজিরাকে বলেন, সে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল, তখন একটি গুলি তার মাথায় বিদ্ধ হয়।
সেই সময়ের উত্তর ত্রিপুরা জেলার পুলিশ সুপার ভানুপদ চক্রবর্তী অবশ্য বলেছিলেন, পুলিশ নির্দিষ্ট করে কাউকে টার্গেট করেনি। আলফেশানির মৃত্যুর কারণ তদন্তাধীন রয়েছে।
তবে পুলিশের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছে তার পরিবার। আলফেশানির মা আলিফজান বেগম বলেন, পুলিশই ছেলের মাথায় গুলি করেছে। আমার হৃদয়ের আগুন কখনো নেভানো যাবে না। এটি একটি হত্যাকাণ্ড ছিল।
এর আগে মুসলিমদের একটি প্রতিনিধি দল স্থানীয় পুলিশকে মুসলিম গাড়িচালক ও যাত্রীর উপর হামলার জন্য দায়ীদের গ্রেপ্তার করার আহ্বান জানিয়েছিল। চালক ও নারী যাত্রীকে মারধরের অভিযোগে কদমতলা থানার পুলিশ দু`জনকে গ্রেপ্তার করে। মূলত স্থানীয় মুসলিমদের বিক্ষোভের পর তাদের আটক করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুসলিম প্রতিনিধি দলের এক সদস্য জানান, দুর্গাপূজা আয়োজক ক্লাবের সদস্য ফেসবুকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে `উস্কানিমূলক মন্তব্য` করার পর উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। আল-জাজিরা সেটি ভেরিভাই করেও দেখেছে।
ক্ষুব্ধ মুসলিমদের একটি গ্রুপ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় ওই যুবককে খুঁজতে নামে। কদমতলা মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি বিভু দেবনাথ আল জাজিরাকে বলেন, তারা পাথর নিক্ষেপ করে এবং দরজা-জানালা ভেঙে ফেলে, হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে এবং হিন্দু ছেলেটিকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে। এতে হিন্দুরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
নরেন্দ্র মোদির বিজেপির আদর্শিক উৎস হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠীগুলো কদমতলা বাজারে কয়েকটি মুসলমানের দোকানে ভাঙচুর চালায়। দুই গ্রুপের দাঙ্গা তীব্র হয়ে উঠলে আলফেশানি ওই সময় পালানোর চেষ্টা করেন। তবে তিনি তা পারেননি।
বেছে পুড়িয়ে দেওয়া হয়
৮ অক্টোবর সকালে ৪০ বছর বয়সী সুহেল আহমেদ খান কদমতলা বাজারে নিজের দোকানে যান। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের পথ ছিল। কিন্তু সহিংসতার কারণে সেখানে যাওয়ার জন্য নিরাপদ অনুভব করতে তার দুই দিন সময় লেগেছিল।
কেননা একদিন আগেও ৭ অক্টোবর কদমতলার বাইরে থেকে স্থানীয় হিন্দু এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত বজরং দলের সঙ্গে যুক্ত লোকজন বাজারের উপকণ্ঠে জড়ো হয়েছিল। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কংগ্রেসের হীরা লাল নাথ বলেন, এরপর ওই লোকগুলো বাজারে গিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে ও লুটপাট চালায়। ত্রিপুরায় আরএসএসের প্রচারের দায়িত্বে থাকা তাপস রায় অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এটি এমন একটি দোকান, যেখানে সুহেল আহমেদ তার সারা জীবনের সঞ্চয় বিনিয়োগ করেছিলেন। তিনি বলেন, `৫৭ লক্ষ টাকার বেশি আগুনে পুড়ে গেছে। এই ক্ষতির সাথে আমার জীবন মৃত্যুতে পরিণত হয়েছে।`
এটা ছিল সম্মিলিত শাস্তি
কথা বলতে হিমশিম খেতে খেতে সুহেল আহমেদ বলেন, `তারা আমাদের মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে।`
কদমতলা বাজারের ঠিক মাঝখানে ৭ অক্টোবর কদমতলা জামে মসজিদেও আগুন ধরিয়ে দেয় উন্মত্ত জনতা। কদমতলা জামে মসজিদ কমিটির উপদেষ্টা আবদুল মতিন আল জাজিরাকে বলেন, তারা সব ধর্মীয় বই পুড়িয়ে ফেলেছে।
বাজারের উপকণ্ঠে সরসপুর পাড়ায় ৪০ বছর বয়সী ইসলাম উদ্দিন তার পুড়ে যাওয়া বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করছেন। তার বাড়িটি মুসলিম মালিকানাধীন ১০টি বাড়ির মধ্যে ছিল, যা একটি উল্লেখযোগ্য হিন্দু জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত। সেগুলো ৭ অক্টোবর একই দিনে উন্মত্ত হিন্দু জনতা জ্বালিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, আমাকে ও আমার পরিবারকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে।
তার প্রতিবেশী আতারুন নেসা, তার বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি এখন স্থানীয় এনজিওর কাছ থেকে দান করে বেঁচে আছেন। তার পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস – স্বামী সিরাজ উদ্দিন যে ই-রিকশাটি চালাতেন, সেটিও হিন্দু জনতা পুড়িয়ে দেয়।
৪৭ বছর বয়সী আতারুন নেসা কান্নায় ভেঙে পড়ে আল জাজিরাকে বলেন, আমাদের জন্য এক টুকরো খাবার জোগাড় করার একমাত্র উপায় ছিল রিকশাটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছেন, ৭ অক্টোবর উত্তেজিত হিন্দু জনতা যখন তাণ্ডব চালাচ্ছিল, তখন পুলিশ `দর্শকের` মতো দাঁড়িয়ে দেখছিল।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী) স্থানীয় বিধায়ক ইসলাম উদ্দিন দাবি করেছেন, পুলিশই আগুন লাগানোর অনুমতি দিয়েছে। পুলিশ চাইলে হিন্দু জনতাকে থামাতে পারত। মনে হচ্ছিল তারা একটি পক্ষ বেছে নিয়েছে।
বিরোধী দল কংগ্রেসের বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মন বলেন, কদমতলার হিংসা বিজেপির রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে। বিজেপি মুসলিমদের উস্কানি দিতে চেয়েছিল।
উত্তর ত্রিপুরার তৎকালীন পুলিশ সুপার চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আল জাজিরাকে বলেন, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি সঠিক ব্যক্তি নই।
ত্রিপুরার পুলিশ প্রধান অমিতাভ রঞ্জনকে আল জাজিরা ফোন করলেও সাড়া দেননি। আল জাজিরা তার অফিসে একটি বিস্তারিত প্রশ্নপত্রও পাঠিয়েছে, কিন্তু এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তিনি অবশ্য এর আগেও সহিংসতার সময় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
মুসলিমরা আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে
কদমতলার সংঘর্ষ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ত্রিপুরায় আন্তঃধর্মীয় সহিংসতার সর্বশেষ উদাহরণ মাত্র। আগস্ট ও অক্টোবরে বারবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার পর `মুসলমানরা হিন্দু দেবদেবীদের বিকৃত করছে`-এমন অভিযোগ তুলে প্রতিশোধ নিতে মসজিদে হামলা চালানো হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুসলিমদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
ত্রিপুরা-ভিত্তিক মুসলিম ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক অর্গানাইজেশন অফ ইন্ডিয়ার জাতীয় সম্পাদক সুলতান আহমেদের জন্য, এই সাম্প্রতিক আক্রমণগুলো ২০২১ সালে রাজ্যের বিশাল অংশে ছড়িয়ে পড়া বিধ্বংসী দাঙ্গার স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয়। ত্রিপুরার মুসলিমরা এখনো আতঙ্কে বাস করছেন।
উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত বিশাল হিন্দু জনতা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বিশেষ করে উত্তর ত্রিপুরায় মুসলিমদের বাড়িঘর ও মসজিদে হামলা চালায়। এরপর থেকে বাংলাদেশেও হিন্দুদের ওপর কোনো ঘটনা উত্তর ত্রিপুরায় বসবাসকারী মুসলিমদের আতঙ্কে ফেলে দেয়।
হিন্দুরা বদলে গেছে
ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যের উপজাতি সম্প্রদায় এবং বাঙালিদের মধ্যে জাতিগত সহিংসতা দেখা গেছে। ঘুমন্ত পার্বত্য রাজ্যটিতে ২০১৮ সালে মোদীর বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে সংঘর্ষের ইতিহাস নেই।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্তঃধর্মীয় সহিংসতার পরিসংখ্যান প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজ্যব্যাপী দাঙ্গা নিয়ে সরকারি তথ্যে দেখানো হয়েছে, ত্রিপুরায় দুটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং সেগুলো ২০১৯ সালে।
তবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) এক আইনপ্রণেতা বলেন, ২০১৮ সাল থেকে বহু ক্ষেত্রে হিন্দু গোষ্ঠীগুলো `সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ উস্কে দেওয়ার` চেষ্টা করার পর থেকে সহিংসতা তীব্রভাবে বেড়েছে।
ঘটনাগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে- ডানপন্থী দলগুলো রাজ্যে মুসলমানদের মালিকানাধীন রাবার বাগানে হামলা চালাচ্ছে। এছাড়া মসজিদের স্থানে দাবি করা হচ্ছে মন্দির। হিন্দু উন্মত্ত জনতার হাতে মুসলিম পুরুষদের গণপিটুনির ঘটনাও বেড়েছে।
তবে ত্রিপুরায় বিজেপির মুখপাত্র সুব্রত চক্রবর্তী আল জাজিরাকে বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে এ ধরনের কোনো গোষ্ঠী সুবিধা পায় না। এই সরকার সক্রিয়, উন্নয়নমুখী সরকার।
এদিকে কদমতলার সবশেষ উত্তেজনা এখনো রয়েই গেছে। হিন্দু উন্মত্ত জনতা যেসব দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়, সেখানে আর কেউ কিছু কিনতে চায় না। সোহেল বলছিলেন, যে সম্প্রীতি ছিল, তা ফিরে আসতে কয়েক বছর সময় লাগবে, অথবা সম্ভবত কখনই নয়।
কদমতলায় বিজেপির সংখ্যালঘু শাখার প্রাক্তন সদস্য আবদুল হকের কাছে সাম্প্রতিক সহিংসতা ছিল `বৃহত্তর পরিবর্তনের প্রতীক`। তিনি বলেন, আগে হিন্দু উৎসবের সময় লাউডস্পিকার এমনভাবে লাগিয়ে দিতেন যাতে মুসলিমরা বিরক্ত না হন, কিন্তু এখন লাউডস্পিকারে উস্কানিমূলক গান বাজানো হচ্ছে। হিন্দুরা এখানে বদলে গেছে।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন