বিশ্বের হিমবাহগুলোর মোট ভরের প্রায় ৪০ শতাংশ ইতোমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেছে। যদি এখনই তাপমাত্রা বৃদ্ধি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, তবুও ২০২০ সালের তুলানায় প্রায় ৩৯ শতাংশ বরফ গলে যাবে।
অর্থাৎ এই সংখ্যক বরফ গলা এখন আর ঠেকানো সম্ভব নয়। এর পরে যা-ই ঘটুক না কেন, এই বরফ গলার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা গড়ে ১১৩ মিলিমিটার বাড়বেই। সাম্প্রতিক এক গবেষণার এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।
বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র অনুসারে, বিশ্বে বিদ্যমান জলবায়ু নীতি এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, তাহলে হিমবাহের ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত গলে যেতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রায়োস্ফিয়ার ক্লাইমেট ইনিশিয়েটিভের হিমবাহবিদ জেমস কিরখাম সিএনএনকে বলেন, ‘সেচ, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের জন্য হিমবাহের গলিত পানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর জন্য পরবর্তী পরিস্থিতি বিপর্যয়কর হতে পারে। ৩৯ শতাংশ বরফ হারানো আর ৭৬ শতাংশ বরফ হারানোর মধ্যে পার্থক্যটা হলো—একটাতে মানুষ মানিয়ে নিতে পারে, অন্যটায় পারে না।’
তবে এই হতাশার মধ্যেও গবেষকরা কিছু আশার কথা বলছেন। গবেষণার অন্যতম নেত্রী অস্ট্রিয়ার ইনসব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লিলিয়ান শুস্টার বলেন, ‘প্রত্যেক ০.১ ডিগ্রি কম উষ্ণতা মানে আমরা আরও কিছু হিমবাহ রক্ষা করতে পারি।’

বিশ্ব উষ্ণায়ন সীমিত করার জন্য ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে প্রায় ২০০টি দেশ একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রাক-শিল্প স্তরের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এবং সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রির নিচে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশগুলো। প্রতিটি দেশ এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজস্ব পরিকল্পনা তৈরির জন্য কাজ করছে।
কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি খুব খারাপ, বর্তমান হারে এগোতে থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা ২.৯ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। গবেষণাটি বলছে, ১.৫ থেকে ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে প্রতি ০.১ ডিগ্রিতে বিশ্বব্যাপী হিমবাহ ২ শতাংশ পর্যন্ত গলে যাবে।
গবেষণার সহ-প্রধান হ্যারি কেকোলারি বলেন, ‘আমরা আন্দোলনকারী নই, আমরা শুরু বৈজ্ঞানিক তথ্য তুলে ধরছি।’ তিনি জানান, অনেকেই বলেন আমরা ভয় পাইয়ে দিচ্ছি। এর জবাব হলো- ‘আমি শুধু আমাদের কম্পিউটারের তথ্য তুলে ধরছি।’ হ্যারি বেলজিয়ামের ভ্রিজে ইউনিভার্সিটি ব্রাসেল ও সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখের একজন গবেষক।
শনিবার (০১ জুন) জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করার সময় জেমস কিরখাম বলেন, এই গবেষণাটি ‘চলতি দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিমবাহ সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীমূলক কাজগুলোর একটি’।

পূর্ববর্তী গবেষণাগুলো সাধারণত ভবিষ্যদ্বাণী করত ২১০০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু হিমবাহের বরফ পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া ধীরে ঘটে— অনেক সময় ধরে, বছর বা শতাব্দীও লাগতে পারে। ফলে প্রকৃত ক্ষতির প্রভাব অনেক পরে বোঝা যায়।
এই গবেষণায় আটটি আলাদা হিমবাহ মডেল ব্যবহার করে শতাব্দীজুড়ে সিমুলেশন চালানো হয়েছে। এতে দেখা গেছে, যদি বর্তমান তাপমাত্রাই স্থায়ী হয়, তাহলে হিমবাহের গড় বরফ হারাবে ৩৯ শতাংশ, যার সীমা ১৫-৫৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠানামা করে।
গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত আইসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গুডফিন্না আদালগেইর্সদোত্তির সিএনএনকে বলেছেন, ‘তবে এই ভিন্নতা সত্ত্বেও একটিই বার্তা স্পষ্ট যে, তাপমাত্রা যত বাড়বে, হিমবাহের বরফ তত হারাবে।’
গবেষণায় দেখা গেছে, অঞ্চলভেদে প্রভাব আলাদা হতে পারে। পশ্চিম কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর-পূর্ব কানাডা, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও রুশ আর্কটিক অঞ্চলের হিমবাহগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে।
আপনার মতামত লিখুন :