ইসরায়েলের নিজের দেশে পারমাণবিক অস্ত্র আছে কী না, তা তারা স্বীকারও করে না আবার অস্বীকারও করে না। তবে আন্তর্জাতিক মহল বিশ্বাস করে, তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। মূলত এই ধারণা তৈরি হয় ইসরায়েলি পরমাণু প্রকৌশলী মোরেখাই ভানূনুর কারণে।
ইসরায়েল কীভাবে গোপনে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে, তা ভানূনুর ফাঁস করা তথ্যের মাধ্যমেই জানতে পেরেছিল গোটা বিশ্ব। ওই তথ্য ফাঁসের ফলে যদিও তাকে প্রায় দুই দশক জেলে থাকতে হয়েছিল।
১৯৮৬ সালের অক্টোবরে লন্ডনের পত্রিকা দ্য সানডে টাইমস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, 'রিভিলড্ – দ্য সিক্রেটস অফ ইসরায়েলস্ নিউক্লিয়ার আর্সেনাল', অর্থাৎ ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের গোপন তথ্য ফাঁস।
মনে করা হয়, এই খবরটি ব্রিটিশ সাংবাদিকতায় সব থেকে বড় স্কুপ খবরগুলোর মধ্যে অন্যতম।
খবরের সূত্র ছিলেন ইসরায়েলি পরমাণু প্রকৌশলী মোরেখাই ভানূনু। অনেকেই যেটা সন্দেহ করতেন যে, ইসরায়েল পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে, সেই সন্দেহের নিরসন হয় তার ফাঁস করে দেওয়া তথ্য দিয়েই। জেরুজালেমের প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে নেগেভ মরুভূমির মাঝে অবস্থিত অতি গোপন ডিমোনা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে চাকরি করতেন মোরেখাই ভানূনু।
তার দেওয়া তথ্যের ওপরে ভিত্তি করেই 'দ্য সানডে টাইমস' লিখেছিল যে, ইসরায়েল বিশ্বের ষষ্ঠ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে এবং তাদের কাজে ২০০টির মতো পারমাণবিক অস্ত্র মজুত আছে।
দ্য সানডে টাইমসের তদন্তমূলক সাংবাদিক পিটার হাউনাম বিবিসিকে বলেছিলেন, আমরা খুব উদ্বেগে ছিলাম, ক্লান্তিও লাগছিল সবার, কেউই তো এত বড় একটা খবর এর আগে কখনও করে নি।
তবে যে ৫ অক্টোবর ওই প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল, সেদিনই তাদের খবরের মূল সূত্র ছিলেন যিনি, তিনি নিখোঁজ হন।
মোরেখাই ভানূনু তথ্য ফাঁস করার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে খুবই কম জানা ছিল। এমনকি তাদের সবথেকে কাছের মিত্র দেশগুলোও এই তথ্য জানত না।
মনে করা হয়, ১৯৪৮ সালে দেশটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছিল। শত্রু দেশের সংখ্যা প্রচুর, তাই পারমাণবিক বোমা একটা নিরোধকের কাজ করবে এমনটাই পরিকল্পনা ছিল ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুর্যিয়নের। তবে একটা অস্থির অঞ্চলে কোনো অপ্রচলিত অস্ত্র মজুত করে তিনি ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোকেও চটাতে চান নি। তাই ডিমোনা কারখানা গড়তে ফ্রান্সের সঙ্গে একটা গোপন চুক্তি করে ইসরায়েল। ধারণা করা হয় যে পারমাণবিক বোমার জন্য উপাদান তৈরির কাজ ৬০এর দশকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে। বহু বছর ধরে ইসরায়েল ওই কারখানাটিকে একটি কাপড় তৈরির কারখানা বলে প্রকাশ করতো।
যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকরা ওই কারখানায় ৬০-এর দশকেই একাধিকবার ঘুরে গেছেন। কিন্তু মাটির তলায় যে আরও বেশ কয়েকটি তল রয়েছে, সেটা তারা সম্ভবত বুঝতে পারেন নি। লিফট আর প্রবেশদ্বারগুলো ইটের গাঁথনি দিয়ে তারপরে প্লাস্টার করে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।
সেন্টার ফর আর্মস কন্ট্রোল আ্যন্ড নন-প্রলিফারেশনের হিসাব অনুযায়ী, এখন ইসরায়েলের কাছে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক বোমা আছে। তবুও ইসরায়েল তার পারমাণবিক ক্ষমতা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবেই একটা অস্পষ্টতার নীতি নিয়ে চলে।
ইসরায়েলের নেতারা অনেক বছর ধরেই বারবার একটা কথা বলে আসছেন যে, ইসরায়েল কখনই মধ্য প্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী প্রথম দেশ হয়ে উঠবে না।
পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধ ও নিরস্ত্রীকরণের ধারণা ছড়িয়ে দিতে সেই ১৯৭০ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত ১৯১ টি রাষ্ট্র ট্রিটি অন দ্য নন-প্রলিফারেশন অফ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস্ বা এনপিটি-তে সই করেছে। এই চুক্তি বাংলায় পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি নামে পরিচিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং চীন – এই পাঁচটি দেশের পারমাণবিক অস্ত্র রাখার অনুমোদন রয়েছে, কারণ এদের প্রত্যেকেই ১৯৬৭ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে ওই চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগেই পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেছিল। ওই চুক্তিতে সই করে নি ইসরায়েল ।
সেদেশে ভানূনুকে বিশ্বাসঘাতক বলে মনে করা হলেও ২০০৪ সালে তিনি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তার সমর্থকরা উৎসব পালন করেছিলেন। তাকে 'শান্তির নায়ক' নামে ডাকা হত।
মুক্তি পাওয়ার পরে তার প্রথম সাক্ষাতকারে বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, আমার কোনো অনুশোচনা নেই।
তিনি বলেন, গোপনে কী কর্মকান্ড চলছে, আমি সেটা বিশ্বকে জানিয়েছি। আমি তো বলি নি যে আমাদের উচিত ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া হোক, কিন্তু ডিমোনা ধ্বংস করা হোক। আমি শুধু তুলে ধরেছি যে, এদের কাছে কী রয়েছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তো অন্যদের।
আপনার মতামত লিখুন :