এ যেন ‘জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ’ অবস্থা। গাজা উপত্যকাজুড়ে হয় অনাহারে অথবা বুলেটে মৃত্যুর ফাঁদ পেতে বসে আছে বর্বর ‘ইসরায়েল’। দেশটির নির্বিচার হামলার পাশাপাশি তীব্র খাদ্যসংকটে ভুগে মরছে গাজার বাসিন্দারা। অনাহার-অর্ধাহারে দিনের পর দিন কাটাতে হচ্ছে উপত্যকাটির অসহায় শিশুদের। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ২১ মাসের বেশি সময় ধরে চলা সংঘাতে উপত্যকাটিতে অপুষ্টিতে ভুগে ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের ৮০ জনই শিশু বলে জানায় উপত্যকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এদের মধ্যে সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের।
অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পরিচালিত বিতর্কিত ত্রাণসহায়তা কেন্দ্রগুলোতে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে নির্বিচার গুলির মুখে পড়ছেন ফিলিস্তিনিরা। ৭ মে থেকে ত্রাণকেন্দ্রগুলোর কাছে হত্যা করা হয়েছে ১ হাজারের বেশি মানুষকে।
গাজায় ত্রাণসহায়তা পরিচালনাকারী গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-কে মৃত্যুকূপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি ত্রাণ ও শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)। সংস্থাটির প্রধান ফিলিপ লাজ্জারিনির মতে, জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রগুলো হলো মৃত্যুর ফাঁদ। ত্রাণ নিতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের স্নাইপাররা নির্বিচার গুলি করেন, যেন তাদের হত্যা করার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, গাজায় বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ মানুষ ক্ষুধায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সালমিয়া। এর মধ্যে ৭০ হাজার শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন তিনি।
শুধু গাজার বাসিন্দারা নন, অনাহারে ভুগছেন জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউর কর্মী ও চিকিৎসকেরাও। সংস্থাটির প্রধান ফিলিপ লাজ্জারিনি মঙ্গলবার (২২ জুলাই) এক বিবৃতিতে বলেছেন, অনাহার ও অবসাদের কারণে তাদের অনেক কর্মী ও চিকিৎসক কাজ করতে করতে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছেন। কর্মীদের কাছ থেকে এমন ঘটনার কয়েক ডজন বার্তা পেয়েছেন তিনি।
গাজার দক্ষিণে খান ইউনিসের আল নাসের হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন কানাডার অর্থোপেডিক সার্জন ডিরড্রে নুনান। আল জাজিরাকে তিনি জানিয়েছেন, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় বহু চিকিৎসককে ২৪ ঘণ্টার শিফটে কাজ করতে হচ্ছে—তবে তারা পাচ্ছেন মাত্র একটি অপ্রতুল ও অপরিপূর্ণ খাবার।
ডা. নুনান জানান, প্রতিদিন দুপুরের পর একটি মাত্র খাবার সরবরাহ করা হয়। সেটাও খুবই সাধারণ। যেমন গতকাল ছিল শুধু সেদ্ধ ডাল, আর কয়েকদিন আগে ছিল ভাতের সঙ্গে কয়েকটি শস্যদানা। এতে পুষ্টি তো পূর্ণ হয় না, বরং একজন পূর্ণদিবস কাজ করা কর্মীর জন্য পর্যাপ্ত ক্যালোরিও নেই।
এদিকে, নুনানের এক সহকর্মীর অবস্থা আরও ভয়াবহ। প্রতিদিন সকালে তিনি একটি রুটি চার টুকরো করে নিজের চার সন্তানের জন্য দেন। কাজ শেষে বাসায় ফিরে আবার সেই একইভাবে ভাগ করেন।
খাদ্য সংকটের কারণে গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ইতোমধ্যে চরম সংকটে রয়েছে। ওষুধ, খাদ্য, জ্বালানি ও নিরাপত্তার অভাবে সেখানে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করছেন চরম চাপের মধ্যে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজায় একটি নিরাপদ ও মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য আহ্বান জানালেও পরিস্থিতির কোনো দৃশ্যমান উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে গাজায় অবস্থান করা সাংবাদিকেরাও অনাহারে মারা যেতে পারেন বলে উল্লেখ করেছে বার্তা সংস্থা এএফপির সাংবাদিকদের সংগঠন। এক চিঠিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই সাংবাদিকদের এভাবে মৃত্যুর মুখে পড়তে দেওয়া যাবে না। পরে এএফপির পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে গাজায় অবস্থান করা সংস্থাটির সাংবাদিকদের বেহাল দশার কথা স্বীকার করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনে এমন অসহায় অবস্থার মধ্যে গাজায় বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) ভোর থেকে উপত্যকাটিতে অন্তত ৫১ জনকে হত্যা করেছে ‘ইসরায়েল’ বাহিনী। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ‘ইসরায়েল’র হামলায় সেখানে ৫৯ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ‘ইসরায়েল’কে ‘এখনই যুদ্ধ থামানোর’ আহ্বান জানিয়ে সোমবার (২১ জুলাই) যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ২৮টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। তাদের মতে, গাজায় ‘মানুষের দুর্ভোগ এক নতুন গভীরতায় পৌঁছেছে।’ বিবৃতিতে সমঝোতার ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতি, জিম্মিদের মুক্তি এবং জরুরি মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবাহের আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে এই বিবৃতিকে ‘বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন’ বলে উল্লেখ করেছে ‘ইসরায়েল’।