গাজায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের গণহত্যায় এখন পর্যন্ত ৬৩ হাজার ৬৩৩ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। মানবিক এই বিপর্যয়ের কারণে দেশটিকে সমর্থনের জন্য বিশ্বের অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো এগিয়ে এসেছে।
দেশগুলো কর্তৃক ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নতুন নয়- ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে এই যাত্রা শুরু হয়। গত দশকেও পশ্চিমা কিছু দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
চলতি বছরের ২৪ জুলাই ফ্রান্স ঘোষণা করে, তারা আগামী ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেবে। এতে জি-৭-এর মধ্যে ফ্রান্স প্রথম দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করবে।
ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তির জন্য এই ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে।’
ফ্রান্সের এই ঘোষণার পর ৩০ জুলাই কানাডা এবং ১১ আগস্ট অস্ট্রেলিয়াও একই পথে এগিয়েছে।
রাষ্ট্রীয়তা কী?
আন্তর্জাতিক আইন ও রাজনৈতিক তত্ত্বে রাষ্ট্রত্ব একটি বিতর্কিত ধারণা হলেও, সহজ ভাষায় বলতে গেলে, একটি রাষ্ট্র হল এমন একটি রাজনৈতিক সত্তা যার একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব থাকে- যা তাকে অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন করে তোলে।
১৯৩৩ সালে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত মন্টেভিডিও কনভেনশন একটি রাষ্ট্রের জন্য চারটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে- ১. একটি স্থায়ী জনসংখ্যা, ২. একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, ৩. একটি স্বাধীন সরকার, এবং ৪. অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষমতা।
যদিও এই মানদণ্ডগুলো ব্যাপকভাবে গৃহীত, আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যতামূলক নয়। ফলে সেগুলো নমনীয়ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- বিশেষ করে ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে।
ফিলিস্তিন জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য না হলেও, বিশ্বের অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে অংশ নিচ্ছে।
রাষ্ট্রের মর্যাদা কে নির্ধারণ করে?
কোনো একক সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রত্ব প্রদান করে না, তবে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের সমান ভোটাধিকার থাকে- যেমন টুভালু ও ভারতের ভোটাধিকার সমান। তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের (UNSC) পাঁচ স্থায়ী সদস্য-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এবং যুক্তরাজ্যের- অধিক প্রভাব রয়েছে।
বিশ্বের কিছু স্ব-ঘোষিত সরকার যেমন- সোমালিল্যান্ড, ট্রান্সনিস্ট্রিয়া এবং তাইওয়ান- নিজস্ব সরকার, সেনাবাহিনী ও আইন থাকলেও, সার্বজনীন স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হতে পারেনি।
জাতিসংঘে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেতে কী কী লাগে?
জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার তিনটি প্রধান ধাপ-
১. আবেদন: সম্ভাব্য রাষ্ট্র জাতিসংঘের মহাসচিবকে সদস্যপদ গ্রহণের আনুষ্ঠানিক আবেদন জানায়।
২. সুপারিশ: জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগে- ১৫ সদস্যের মধ্যে ৯ জনের সম্মতি এবং স্থায়ী সদস্যদের কেউ ভেটো না দিলেই সুপারিশ গৃহীত হয়।
৩. গৃহীত হওয়া: সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সদস্যপদ নিশ্চিত হয়- যা ফিলিস্তিন এরই মধ্যে অর্জন করেছে।
ফিলিস্তিনিদের কাছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রতীক। স্বীকৃতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সীমান্ত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় এবং অন্যান্য রাষ্ট্র তা সম্মান করতে বাধ্য থাকে।
এক্ষেত্রে, স্বীকৃতি প্রদানকারী রাষ্ট্রগুলোর উচিত হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৩৩৪ নম্বর রেজোলিউন এবং ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের উপদেষ্টা মতামতের আলোকে ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস
১৯৪৮: ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের ১৮১ নম্বর প্রস্তাব অনুসারে ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। ব্রিটিশদের প্রত্যাহারের পর ইহুদি মিলিশিয়ারা হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করে। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা দ্রুত স্বীকৃতি দেয়। ফিলিস্তিনিরা তখনো রাষ্ট্রহীন ছিল।
১৯৭৪: জাতিসংঘে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-কে ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং পিএলওকে সদস্যবিহীন পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেওয়া হয়।
১৯৮৮: আলজিয়ার্সে নির্বাসিত পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা দ্রুত আরব বিশ্বে স্বীকৃতি পায়, কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়।
১৯৯৩: অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এর ফলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) গঠিত হয় এবং কিছু সীমিত স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। তবে, ইসরায়েলে রাবিনের হত্যার পর শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশাবাদ নষ্ট হয়।
২০১১ থেকে বর্তমান: ২০১১ সালে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সদস্যপদে আবেদন করে, এরপর আইসল্যান্ড প্রথম পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। ২০১২ সালে ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘে অ-সদস্য ‘পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’ হিসেবে উন্নীত করা হয়। ২০২৩ সালে গাজার সংঘর্ষের পর, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, স্পেন এবং অন্যান্য দেশ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিয়ে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ আটকে দিয়েছে। গত বছরের একটি জরুরি অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের অধিকাংশ অধিকার দেওয়া হলেও পূর্ণ সদস্যপদ এখনো প্রাপ্ত হয়নি।
জাতিসংঘের নতুন পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ
চলতি বছরের জুলাইয়ে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ সভাপতিত্বে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির বিষয়ে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি প্রদানের পক্ষে মত দেয়, যদিও ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সম্মেলন বয়কট করে। এতে হামলার নিন্দা, যুদ্ধবিরতি, জিম্মি মুক্তি এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের আহ্বান জানানো হয়।
বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যের মধ্যে ১৪৭টি দেশ, এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। ভ্যাটিকানসহ ১৪৯টি রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে। ফ্রান্স ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ এগিয়ে এলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করছে বিশ্লেষকরা।
পরবর্তী ধাপ ও চ্যালেঞ্জ
আগামী ৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে, যেখানে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্য রাখবেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন পেতে ফিলিস্তিনকে পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে অন্তত চারটির সমর্থন লাগবে। এরই মধ্যে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও চীন সমর্থন জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো একমাত্র স্থায়ী সদস্য যারা বাধা সৃষ্টি করছে।
গবেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই একতরফা মনোভাব হয়তো ফিলিস্তিনের পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। তবে কিছু বিশ্লেষকের ধারণা, অন্যান্য পরাশক্তির চাপ ও আন্তর্জাতিক জনমতের কারণে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন