মিয়ানমারের আটক গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির ছোট ছেলে কিম আরিস তার মায়ের মুক্তির দাবিতে মুখ খুলেছেন। দীর্ঘদিন নীরব থাকা লন্ডনে বসবাসরত অ্যারিস জানান, তার ৮০ বছর বয়সি মায়ের স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। তিনি কারাগারে জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন।
৪৮ বছর বয়সি অ্যারিস চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তিনি যেন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর প্রভাব খাটিয়ে তার মায়ের মুক্তির দাবি তোলেন। তিনি বলেন, ‘চীনের সঙ্গে জান্তার গভীর সম্পর্ক ও দেশটিতে তাদের বিপুল বিনিয়োগের কারণে বেইজিংই এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রভাবশালী বিদেশি শক্তি।’
অ্যারিসের ভাষায়, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে অনুরোধ করছি, তিনি যেন আমার মায়ের মুক্তির জন্য প্রকাশ্যে আহ্বান জানান এবং জান্তার ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করেন… যাতে যাদের মুক্তি পাওয়া উচিত, তারা মুক্তি পান।’
তিনি জানান, চীনের পক্ষ থেকেও সু চির মুক্তি নিয়ে আগ্রহ দেখানো হয়েছে, তবে কোনো বিদেশি কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পাননি। তিনি বলেন, ‘যদি কেউ অন্তত একবার দেখতে পেতেন, তাহলে নিশ্চিত হওয়া যেত যে তিনি এখনো জীবিত আছেন।’
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টে জাতিসংঘের এক অনুসন্ধানী সংস্থা জানিয়েছে, মিয়ানমারের কারাগারগুলোতে ব্যাপক নির্যাতন চলছে। সেখানে আটক ব্যক্তিদের ওপর মারধর, বৈদ্যুতিক শক, গণধর্ষণ, শ্বাসরোধ এবং নখ তুলে নেওয়ার মতো নির্মম আচরণ করা হচ্ছে।
সু চি ১৯৮৯ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে মোট ১৯ বছর ধরে আটক রয়েছেন। প্রথমে গৃহবন্দি, এখন কারাগারে নিরালায়। ১৯৯১ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান, যা তার দুই ছেলে তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করেন।
মিয়ানমারের নির্বাসিত ছায়া সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) সতর্ক করেছে, যদি সু চি কারাগারে থাকেন বা সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে দেশের সংকট আরও গভীর হবে।
এনইউজির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মন্ত্রী ড. সাসা বলেন, ‘তার অনুপস্থিতি দেশকে আরও বিভক্ত করবে, সংঘাত দীর্ঘায়িত করবে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।’
অ্যারিস জানান, ১১ বছর বয়সের পর থেকেই তিনি মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। ১৯৮৮ সালে সু চি ইয়াঙ্গুনে ফিরে গেলে তাকে জেনারেলদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্বের দায়ে গৃহবন্দি করা হয়।
তিনি বলেন, সু চির সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সবসময়ই ‘গঠনমূলক ও উৎপাদনশীল’ ছিল। ‘অভ্যুত্থানের আগে আমার মা চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কারণ তিনি জানতেন এটি তার দেশের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
২০২০ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সু চির সাক্ষাতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় ৩৩টি প্রকল্পে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল রাখাইন রাজ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর ও ইয়াঙ্গুনে নতুন শহর নির্মাণের পরিকল্পনা।
বর্তমানে চীন মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশটিতে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার এবং চলতি অর্থবছরেও ইতোমধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ হয়েছে।
কিন্তু অ্যারিস সতর্ক করেছেন, মিয়ানমারের চলমান অস্থিতিশীলতা চীনের জন্যও ঝুঁকি তৈরি করছে। তিনি বলেন, জান্তার পৃষ্ঠপোষকতায় দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ প্রতারণা কেন্দ্র, যেখানে হাজার হাজার চীনা নাগরিককে জোরপূর্বক কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষকে এই ধরনের প্রতারণামূলক প্রতিষ্ঠানে পাচার করা হয়েছে।
অ্যারিস বলেন, ‘চীন নিজেই এই সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেইজিং চায় স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি, কিন্তু বর্তমান জান্তা সেই পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে ৭ হাজারে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে জান্তা নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু বিশ্লেষকরা এটিকে ‘প্রহসন’ বলছেন। কারণ সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিসহ ৪০টিরও বেশি দলকে ভোটে অংশ নিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অ্যারিস বলেন, ‘এই নির্বাচন কেবল দেশকে আরও বিশৃঙ্খলা ও দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দেবে, কারণ কেউ ফলাফল মেনে নেবে না।’ তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘আমার মায়ের মুক্তি না হলে মিয়ানমারের সংকটের কোনো সমাধান সম্ভব নয়।’
সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, দ্য হিন্দু