বাংলাদেশ তুরস্কের কাছ থেকে ‘হিসার ও+’ মাঝারি পাল্লার এবং সিপার (এআইপিইআর) ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার বিষয়ে আলোচনা করছে। চলমান এই আলোচনা দুই মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতার নতুন যুগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। পাশাপাশি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খানের আসেলসান সফর সেই সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রতিরক্ষাবিষয়ক ওয়েবসাইট ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া। তবে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে চীনের তৈরি এফএম-৯০ স্বল্পপাল্লার মিসাইল সিস্টেম। সূত্রে জানা যায়, বেইজিংয়ের কাছ থেকে ২০১১ সালে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি কিনেছিল ঢাকা। এই সিস্টেমটি এখনো সবচেয়ে কার্যকর ভূমিভিত্তিক প্রতিরক্ষা অস্ত্র। এ মিসাইল সিস্টেম ড্রোন, হেলিকপ্টার ও নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান শনাক্ত ও আঘাত হানার জন্য কার্যকর হলেও উচ্চগতির যুদ্ধবিমান বা দূরপাল্লার ক্রুজ মিসাইলের বিরুদ্ধে কার্যকর নয়।
তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ আকাশ প্রতিরক্ষা বলয় গড়ে তুলতে পারেনি। বিশ্বের সামরিক শক্তিগুলো যখন নিজেদের নিরাপত্তা বলয় গঠনে ‘মাল্টি-লেয়ার্ড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’-এর ওপর নির্ভর করছে, তখন বাংলাদেশ এখনো মূলত পুরোনো স্বল্পপাল্লার প্রতিরক্ষা কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ। বিশ্লেষকদের মতে, এটা রীতিমতো উদ্বেগজনক।
এমন বাস্তবায় ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম এই দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ক্রমেই জোরদার করছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ তুরস্ক থেকে প্রায় ২২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে, যা আগামী বছরগুলোতে ‘কয়েক শ মিলিয়ন ডলার’ পর্যন্ত পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ তুরস্কের আধুনিক এআইপিইআর বা সিপার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার চুক্তি চূড়ান্ত করতে পারে বাংলাদেশ। এই উন্নত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেশের আকাশসীমাকে যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের হুমকি থেকে সুরক্ষা দেবে বলে দাবি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের।
চীনা, রাশিয়ান ও ইউরোপীয় আকাশ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ওপর দীর্ঘদিন ধরে নির্ভরশীল বাংলাদেশের জন্য তুর্কি ‘হিসার ও+’ এবং ‘সিপার’ সিস্টেম কেনা যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই সিস্টেমগুলো আকাশসীমায় হুমকির বিস্তৃত পরিসর সনাক্ত, ট্র্যাক এবং প্রতিহত করতে সক্ষম একটি বহু-স্তরবিশিষ্ঠ প্রতিরক্ষা ঢাল তৈরি করবে।
চুক্তিটি এখনো অগ্রসর আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। এতে কেবল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা নয়, রাডার, কমান্ড ও কন্ট্রোল অবকাঠামো এবং দীর্ঘমেয়াদী অপারেশনাল টেকসইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ প্যাকেজও অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে মনে করছে ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া।
চূড়ান্ত ডেলিভারির সময়সূচি এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে সূত্রগুলোর ইঙ্গিত, প্রথমে ‘হিসার ও+’ ব্যাটারি ২০২৬ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে পৌঁছাবে। এবং ২০২৭–২৮ সালের মধ্যে ‘সিপার’ সিস্টেমও বিমান বাহিনীর জন্য প্রস্তুত হবে। প্রতিরক্ষাখাতে এই উন্নয়ন ঢাকা ও আঙ্কারার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য ক্রমশ উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠা আঞ্চলিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার কারণে অস্থিতিশীল ইন্দো-প্যাসিফিক পরিবেশে অপরিহার্য প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে।
ফোর্সেস গোল ২০৩০ পরিকল্পনার অধীনে পশ্চিমা সরঞ্জামগুলোর সঙ্গে আন্তঃকার্যক্ষমতা নিশ্চিত করতে চীনা ও রাশিয়ান সিস্টেমের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। তুর্কি ‘হিসার ও+’ ও ‘সিপার’ প্রস্তাবটি এই লক্ষ্যকে পুরোপুরি সংগত করে।
২০২৫ সালের অক্টোবরেই বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান তুরস্কে উচ্চ পর্যায়ের সফর করেন। এ সময় তিনি তুরস্কের মূল শিল্পখাত টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিএআই), আসেলসান এবং রোকেতসান পরিদর্শন করেন। সফরে হিসার ও সিপার সিস্টেমের পাশাপাশি বায়রাক্টার টিবি২ ও আকিনসি ড্রোনসহ একাধিক সরঞ্জাম কেনার বিষয়ে আলোচনা হয়।
আলোচনাগুলোতে দেখা যায়, ঢাকা একটি সমন্বিত স্তরভিত্তিক আকাশ প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনা করছে। এতে স্থলভিত্তিক ইন্টারসেপ্টর, মনুষ্যবিহীন ড্রোন রিকনাইজেন্স ও কমান্ড ইন্টিগ্রেশন একত্রে চলে। ঢাকা বিশেষভাবে তুরস্কের ‘টার্নকি’ পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং রাডার, কমিউনিকেশন লিংক ও কমান্ড পোস্টসহ পূর্ণাঙ্গ বাস্তুতন্ত্র।
এই মডেল তুরস্কের নিজস্ব ‘স্টিল ডোম’ ধারণার মতোই, অর্থাৎ একই কমান্ড কাঠামোর নিচে স্বল্প থেকে দূরপাল্লার সিস্টেম একীভূত। সব মিলিয়ে, এটি বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে একটি বাস্তবধর্মী ও কৌশলগত পরিসর খুলে দেবে বলেই আশা করছেন বিশ্লেষকরা।
আঞ্চলিকভাবে ‘হিসার ও+’ এবং ‘সিপার’ চুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষমতার ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এখন পর্যন্ত এই খাতে প্রাধান্য ছিল ভারতের রাশিয়ান-সরবরাহকৃত এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ সিস্টেমের। বাংলাদেশের নতুন সিস্টেম এস-৪০০-এর পাল্লায় না পড়লেও এটি একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। বিশেষ করে সংবেদনশীল সীমান্ত এলাকায় এটি আঞ্চলিক বিমান কৌশলকে জটিল করে তুলবে।
বঙ্গোপসাগর ও পূর্ব সীমান্তে কৌশলগত নজরদারি বজায় রাখা ভারতের জন্য বাংলাদেশের এই তুর্কি প্রযুক্তি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এটি তাদের পূর্বাঞ্চলে (সেভেন সিস্টার্স) আকাশসীমায় দাপট কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। নয়াদিল্লির প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া ও থিঙ্ক ট্যাঙ্ক মহলে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। তাদের মতে, ঢাকার এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে আন্তঃসীমান্ত বা আকাশসীমা বিরোধে ‘কৌশলগত হিসাব’ বদলে দিতে পারে।
অন্যদিকে, মিয়ানমার সম্প্রতি চীনা কেএস-১এম ও রাশিয়ান প্যানসির সিস্টেম যুক্ত করেছে। ফলে বাংলাদেশের তুর্কি সিস্টেম কেনা তাদেরও ‘নতুন করে আধুনিকীকরণে বাধ্য করতে পারে’। এই পদক্ষেপের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী চীনের ওপরও, যা ভবিষ্যতে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা সম্পর্কের গতিপথে নতুন অধ্যায় যোগ করতে পারে।
বাংলাদেশি প্রতিরক্ষা বাজারে আঙ্কারার প্রবেশ ঢাকার কৌশলকে বৈচিত্র্যময় করে তুলছে, যা বেইজিংয়ের একচেটিয়া আধিপত্য ধীরে ধীরে কমিয়ে দেবে। চীন, রাশিয়া, পশ্চিমা দেশ ও তুরস্ক সবার সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখা ঢাকার জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে। যদিও প্রতিরক্ষায় নির্ভরতা কমিয়ে সর্বোচ্চ সক্ষমতা অর্জনের পথ খুলে যাচ্ছে ঢাকার।