রুশ বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনের ড্রোন হামলা শুধু দুঃসাহসিকই নয়, ছিল চমকপ্রদও। তবে সবচেয়ে বড় কথা—এটি ছিল নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত এবং নিপুণভাবে বাস্তবায়িত এক অভিযান।
কিয়েভ আঘাত হেনেছে সেখানেই, যেখানে তা সবচেয়ে বেশি পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ধ্বংস করেছে সেইসব যুদ্ধবিমান, যেগুলো প্রায় প্রতিদিনই ইউক্রেনের মানুষদের ওপর আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংস্থা দাবি করেছে, এই হামলায় ৪১টি রুশ যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কৌশলগত বোমারু বিমান ও নজরদারি বিমান। তবে ঠিক কতগুলো বিমান পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়েছে, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলেন, এই হামলা ‘ইউক্রেনের বিশেষ বাহিনীগুলোর জন্য চমকপ্রদ সাফল্য’।

তিনি এক মন্তব্যে লিখেছেন, ইউক্রেনের দাবি করা ৪১টি বিমানের অর্ধেকও যদি সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে থাকে, তাহলে ইউক্রেনীয় শহর ও অবকাঠামোর ওপর রাশিয়ার নিয়মিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রখা এবং একইসঙ্গে ন্যাটো ও জাপানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক শক্তির মহড়া অব্যাহত রাখার সক্ষমতায় বড় ধাক্কা খাবে মস্কো।
রাশিয়ার ভেতর থেকেই আঘাত
বাকি লক্ষ্যগুলো ছিল—মুরমানস্কের কাছে আর্টিক সার্কেলে ওলেনিয়া ঘাঁটি (প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দূরে), রিয়াজান অঞ্চলের দিয়াগিলেভ ঘাঁটি (৫২০ কিলোমিটার দূরে) এবং সামরিক পরিবহন বিমানের ঘাঁটি ইভানোভো (প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে)।
‘স্পাইডারস ওয়েব’ নামে পরিচালিত এসব হামলার লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার অভ্যন্তরে থাকা চারটি বিমানঘাঁটি। সবচেয়ে দূরের ঘাঁটিটি—ইরকুতস্ক অঞ্চলের বেলায়া ঘাঁটি—ইউক্রেন সীমান্ত থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার দূরে।
অন্য লক্ষ্যগুলো ছিল- মুরমানস্কের কাছে আর্কটিক সার্কেলের ওলেনিয়া ঘাঁটি (ইউক্রেন থেকে ২ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে), রিয়াজান ওবলাস্টের দিয়াগিলেভ বিমানঘাঁটি (প্রায় ৫২০ কিলোমিটার দূরে) এবং ইভানোভো ঘাঁটি (প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে), যেখানে রুশ সামরিক পরিবহন বিমান রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।
ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংস্থা এসবিইউ-এর প্রকাশিত একটি চিত্রে পূর্ব আমুর অঞ্চলের আরও একটি ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে এই ঘাঁটিতে হামলা ব্যর্থ হয়েছে নাকি শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
সীমান্ত থেকে এত দীর্ঘ দূরত্বের কারণেই রাশিয়া হয়তো মনে করেছিল, এসব স্থাপনায় বিশেষ নিরাপত্তার দরকার নেই।
বেলায়া ঘাঁটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিমানগুলো খোলা আকাশের নিচে দাঁড় করানো ছিল—যা গুগল ম্যাপসসহ নানা স্যাটেলাইট চিত্রে স্পষ্ট দেখা যায়।
মস্কো সম্ভবত ধরেই নিয়েছিল, দূরত্বই ইউক্রেনের হামলা থেকে তাদের বিমানের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
রাশিয়া এখনো ইউক্রেনের আকাশে আধিপত্য বজায় রেখেছে। ইউক্রেনের মিত্ররা মার্কিন এটিএসিএমএস ও ব্রিটিশ-ফরাসি স্টর্ম শ্যাডোসহ কিছু দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিলেও এসব অস্ত্র রাশিয়ার এত গভীরে আঘাত হানার সক্ষমতা রাখে না।
ইউক্রেন সময় সময় রাশিয়ার অভ্যন্তরে, এমনকি মস্কোতেও নানা লক্ষ্যবস্তুতে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ধীরগতির হওয়ায় রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেগুলো সহজেই শনাক্ত করে ধ্বংস করতে পেরেছে।
তবে এবারের হামলার যে ব্যাপারটি ইউক্রেনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে, সেটি হলো- তারা ড্রোনগুলো সীমান্ত থেকে উড়িয়ে আনেনি। বরং ইউক্রেন গোপনে ড্রোন পৌঁছে দিয়েছে টার্গেটের খুব কাছে এবং সেখান থেকেই হামলা চালিয়েছে।
রুশ প্রতিরক্ষার দুর্বলতা
এই বিমানঘাঁটিগুলোতে রাশিয়ার রাডার ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এত নিচু দিয়ে আসা আকস্মিক হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

এ ধরনের হামলা ঠেকানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ভারী মেশিনগান ব্যবহার। কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের সি-ড্রোন ঠেকাতে রাশিয়া এর আগে এ অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
কিন্তু রোববার যেসব বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে, সেখানে হয় এসব মেশিনগান ছিল না, নয়তো যথাসময়ে মোতায়েন করা হয়নি—সম্ভবত এই কারণে যে রাশিয়া এমন কৌশলে হামলা আসবে ভাবতেই পারেনি।
সিএনএন ঘটনাস্থলের জিওলোকেটেড ছবি ও ভিডিও যাচাই করে দেখেছে, সেগুলো ওই বিমানঘাঁটিগুলোর আশপাশেই তোলা হয়েছে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে হামলাগুলোর সত্যতা স্বীকার করে একে ‘সন্ত্রাসী আক্রমণ’ আখ্যা দিয়েছে। আরও জানিয়েছে, ঘাঁটিগুলোর আশপাশের জায়গা থেকেই আক্রমণ চালানো হয়েছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, এই অভিযানে ১১৭টি ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে।
এসবিইউর তথ্য অনুযায়ী, ড্রোনগুলো তাদের এজেন্টরা চোরাই পথে রাশিয়ায় পাচার করেন। কোনো এক পর্যায়ে, সম্ভবত রাশিয়ার অভ্যন্তরে থাকাকালেই, ড্রোনগুলো ভ্রাম্যমাণ কাঠের কেবিনে লুকিয়ে রাখা হয়।
সিএনএনের হাতে আসা ছবিতে দেখা গেছে, কেবিনের ধাতব ছাদের ঠিক নিচে, ইনসুলেশন ক্যাভিটিতে ড্রোনগুলো গুঁজে রাখা হয়েছে।

এরপর এই কাঠের কেবিনগুলো ট্রাকে তুলে নেওয়া হয় বিমানঘাঁটিগুলোর কাছাকাছি।
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রাকগুলো কীভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটির কাছাকাছি নেওয়া গেল, তা ইউক্রেন জানায়নি। তবে রুশ গণমাধ্যমগুলো বলছে, কাজটা করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
বাজা ও আস্ত্রা নামে দুটি রুশ টেলিগ্রাম চ্যানেল জানিয়েছে, রাশিয়ায় বসবাসকারী একজন ইউক্রেনীয় ব্যক্তি এসব ট্রাক কিনেছিলেন। এরপর তিনি চারজন ড্রাইভারকে ভাড়া করেন, তারা ট্রাকগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেয়।
এসব প্রতিবেদন নিয়ে রুশ বা ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ সরাসরি মন্তব্য করেনি। তবে রুশ রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আরআইএ জানিয়েছে, ইরকুতস্ক অঞ্চলে হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একজনকে খোঁজা হচ্ছে। ওই লোকের নাম বাজা ও আস্ত্রার প্রতিবেদনে বলা নামের সঙ্গে মিলে গেছে।
ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংস্থা বলেছে, তাদের যেসব এজেন্ট এই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, তারা হামলা শুরু হওয়ার আগেই নিরাপদে ইউক্রেনে ফিরে এসেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তারা তিনটি ভিন্ন টাইমজোন জুড়ে একাধিক রুশ অঞ্চলে কাজ করেছেন।
ইউক্রেনের ড্রোন কর্মসূচির একজন সিনিয়র সূত্র সিএনএনকে বলেন, ড্রোনগুলো পরিচালনা করা পাইলটরা সম্ভবত ড্রোন ওড়ানোর জায়গাগুলোর আশপাশেও ছিলেন না।
‘সম্ভবত তারা ইন্টারনেট হাব বসিয়ে নিয়েছিলেন—তার মাধ্যমেই দূর থেকে প্রতিটি এফপিভি (ফার্স্ট পার্সন ভিউ) ড্রোন চালিয়ে একে একে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছেন পাইলটরা।’
তিনি বলেন, এই যোগাযোগ হাব হতে পারে ‘একটি সাধারণ রুশ মোবাইল ফোন’—যা ট্র্যাক করা ইউক্রেনে ব্যবহৃত স্টারলিংক বা অন্য যেকোনো সিস্টেমের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
একটি সূত্র নিশ্চিত সিএনএনকে করেছে, হামলাটি পরিচালিত হয়েছে রাশিয়ার নিজস্ব টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে।
ট্রাকগুলো নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে ড্রোনগুলো হামলার জন্য প্রস্তুত হওয়ার পর কেবিনের ছাদ খুলে যায়—আর সেখান থেকেই ড্রোনগুলো ছুটে যায় লক্ষ্যবস্তুর দিকে।
‘অসাধারণ অভিযান’
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এবং সিএনএন কর্তৃক যাচাইকৃত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব রাশিয়ার ইরকুতস্ক অঞ্চলে একটি ট্রাক থেকে দুটি ড্রোন উড়ে যাচ্ছে।
ড্রোনগুলো বেলায়া বিমানঘাঁটির দিকে ছুটে যাচ্ছে। দূরে ঘন কালো ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়—আগের একটি হামলার ধোঁয়ায় ওখানকার আকাশ ঢেকে গেছে।
একই জায়গার আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ড্রোন পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাকটি বিস্ফোরণে জ্বলছে। সম্ভবত ট্রাকটি যাতে শত্রুর হাতে না পড়ে, সে জন্যই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।
জেলেনস্কি রোববার বলেছেন, এই হামলার প্রস্তুতি চলেছে এক বছর, ছয় মাস এবং নয় দিন ধরে। ‘অসাধারণ’ এই অভিযানের জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি।
রুশ কর্মকর্তারা অবশ্য হামলাটিকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তাদের ভাষ্য, ইভানোভো, রিয়াজান ও আমুর অঞ্চলে হামলা প্রতিহত হয়েছে; তবে মুরমানস্ক ও ইরকুতস্কে হামলার পর ‘কয়েকটি বিমানে’ আগুন ধরে যায়। তবে পরে আগুন নিভিয়ে ফেলা হয় বলে দাবি করেন তারা।
রুশ কর্মকর্তারা বলেন, কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে রুশ কর্তৃপক্ষ যতই ঘটনা লঘু করার চেষ্টা করুক, বেশ কয়েকজন হাইপ্রোফাইল রুশ সামরিক ব্লগার কড়া সমালোচনা করেছেন।
রাইবার নামক এক প্রভাবশালী রুশ সামরিক ব্লগে লেখা হয়েছে, এই হামলায় ‘সমগ্র রুশ বিমানবহরের ভয়াবহ ক্ষতি’ হয়েছে এবং ‘অপরাধজনক গাফিলতির’ ফলেই এমনটি ঘটেছে।
ইউক্রেনের এসবিইউ দাবি করেছে, এই হামলায় প্রতিপক্ষের প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। রাশিয়ার প্রধান বিমানঘাঁটিতে কৌশলগত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রবাহী বিমানের ৩৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। তবে সিএনএন স্বাধীনভাবে এ দাবি যাচাই করতে পারেনি।
ইউক্রেন বলেছে, তারা কয়েকটি টিইউ-৯৫ ও টিইউ-২২এম৩ কৌশলগত বোমারু বিমান এবং রাশিয়ার হাতে থাকা অল্পসংখ্যক এ-৫০ নজরদারি বিমানের একটি ধ্বংস করেছে।

বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত একটি সূত্র বলেছে, ২৭টি টিইউ-৯৫, চারটি টিইউ-১৬০, দুটি টিইউ-২২এম৩ এবং ‘সম্ভবত’ একটি এ-৫০ বিমানে আঘাত হানা হয়েছে।
টিইউ-২২এম৩ হলো রাশিয়ার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রবাহী প্ল্যাটফর্ম। এটি রাশিয়ার আকাশসীমা থেকেই ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মিসাইল নিক্ষেপে সক্ষম।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর ‘মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৫’ প্রতিবেদন অনুসারে, এ বছরের শুরুতে রাশিয়ার বহরে ৫৫টি টিইউ-২২এম৩ এবং ৫৭টি টিইউ-৯৫ জেট ছিল।
টিইউ-৯৫ প্রথম সোভিয়েত বিমানবাহিনীতে যুক্ত হয় ১৯৫০-এর দশকে। রাশিয়া এই বিমানগুলোকে আধুনিকায়ন করে ক্রুজ মিসাইল বহনের উপযোগী করেছে।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট-এর গবেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলেন, এই বিমানগুলোর কয়েকটি বদলানো রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে, কারণ কয়েক দশক ধরেই এগুলো উৎপাদন হয় না।

 
                            -20250603161325.jpg) 
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন