ঢাকা শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৫

কী আছে ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্পের ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনায়

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৫, ০৯:৪৪ পিএম
ট্রাম্প ও জেলেনস্কি। ছবি- সংগৃহীত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে প্রস্তাবিত ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনায় সম্মত হয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার খসড়া করা এই পরিকল্পনায় মস্কো দখলকৃত বিশাল অংশের ভূখণ্ড ছাড়তে বাধ্য করা হবে কিয়েভকে, এমন প্রস্তাবই রয়েছে।

জেলেনস্কি জানিয়েছেন, তিনি আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এসব প্রস্তাব নিয়ে কথা বলবেন। পরিকল্পনাটিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধকালীন দাবি-দাওয়ার অনেক কিছুই প্রতিফলিত হয়েছে।

পরিকল্পনায় যা রয়েছে

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দূতদের প্রস্তাবিত ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনাটি গাজা যুদ্ধবিরতির ধাঁচে তৈরি, যার লক্ষ্য রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন বন্ধ করা। পরিকল্পনায় রাশিয়ার বহু দাবি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা কিয়েভ বহুবার প্রত্যাখ্যান করেছে।

প্রস্তাব অনুযায়ী, ইউক্রেনের ক্রিমিয়া, লুহান্সক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলকে ‘কার্যত রুশ ভূখণ্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু পক্ষ। পরিকল্পনায় ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর আকার সীমিত করার কথা বলা হয়েছে ও ধীরে ধীরে মস্কোর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রস্তাব রয়েছে। ইউক্রেনকে ১০০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতেও বাধ্য করা হবে এবং ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার সব আশা ত্যাগ করতে হবে।

পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে, তবে এর বিনিময়ে ওয়াশিংটনকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নিষেধাজ্ঞা উঠলে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বেও যুক্ত হবে এবং ইউক্রেন পুনর্গঠন ও বিনিয়োগ থেকে সৃষ্ট লাভের ৫০ শতাংশ আমেরিকা পাবে।

২৮ দফা

১. ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা হবে।

২. রাশিয়া, ইউক্রেন ও ইউরোপের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ অ-আগ্রাসন চুক্তি হবে, যাতে গত ৩০ বছরের সব অস্পষ্টতা সমাধান হয়েছে বলে বিবেচিত হবে।

৩. রাশিয়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আক্রমণ করবে না ও ন্যাটো আরও সম্প্রসারিত হবে না- এই বাধ্যবাধকতা থাকবে।

৪. যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে নিরাপত্তা বিষয়ক সব প্রশ্নে সংলাপ হবে, যাতে বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সহযোগিতার সুযোগ বাড়ে।

৫. ইউক্রেন নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পাবে। সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসকে এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রথমবারের মতো এ আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চয়তা আনুষ্ঠানিকভাবে বিবেচনায় এসেছে, যদিও এতে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।

৬. ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৬ লাখে সীমিত থাকবে। বর্তমানে এই সংখ্যা ৮ লাখ থেকে ৮ লাখ ৫০ হাজার।

৭. ইউক্রেন তার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে যে দেশটি ন্যাটোতে যোগ দেবে না। ন্যাটোও তার বিধিতে উল্লেখ করবে যে ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে সদস্য করা হবে না।

৮. ন্যাটো ইউক্রেনে কোনো সেনা মোতায়েন করবে না। এ ধারাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অল্প সংখ্যক ইউরোপীয় সেনা ইউক্রেনে মোতায়েনের প্রস্তাব নিয়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য আলোচনা করছিল। এই পরিকল্পনা সে সম্ভাবনাকে বাদ দিয়েছে।

৯. পোল্যান্ডে ইউরোপীয় যুদ্ধবিমান মোতায়েন থাকবে।

১০. নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতিপূরণ পাবে। ইউক্রেন রাশিয়ায় হামলা চালালে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা হারাবে। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলে সমন্বিত সামরিক প্রতিক্রিয়া ছাড়াও সব নিষেধাজ্ঞা ফিরিয়ে আনা হবে এবং নতুন ভূখণ্ড স্বীকৃতি ও এসব সুবিধা বাতিল হবে। ইউক্রেন যদি অকারণে মস্কো বা সেন্ট পিটার্সবার্গে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা অকার্যকর হবে।

১১. ইউক্রেন ইইউ সদস্য হওয়ার যোগ্য থাকবে ও বিষয়টি বিবেচনায় থাকা অবস্থায় স্বল্পমেয়াদে ইউরোপীয় বাজারে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার পাবে।

১২. ইউক্রেন পুনর্গঠনে প্রযুক্তি, ডেটা সেন্টার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক দ্রুত বর্ধনশীল খাতে বিনিয়োগকারী একটি ইউক্রেন ডেভেলপমেন্ট ফান্ড গঠনসহ শক্তিশালী বৈশ্বিক উদ্যোগ নেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পাইপলাইন, গ্যাস মজুতাগারসহ গ্যাস অবকাঠামো যৌথভাবে পুনর্নির্মাণ, উন্নয়ন ও পরিচালনা করবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা পুনর্বাসন, নগর ও আবাসিক এলাকা আধুনিকীকরণও এর অন্তর্ভুক্ত।

১৩. রাশিয়াকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পুনর্ভুক্ত করা হবে। নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে ও আলাদাভাবে বিবেচনা করে প্রত্যাহার করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া জ্বালানি, প্রাকৃতিক সম্পদ, অবকাঠামো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সেন্টার, আর্কটিকে রেয়ার আর্থ উত্তোলন প্রকল্পসহ পারস্পরিক উন্নয়নকেন্দ্রিক দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তিতে যাবে। রাশিয়াকে আবার জি-৮ এ আমন্ত্রণ জানানো হবে।

১৪. যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইউক্রেন পুনর্গঠন ও বিনিয়োগে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার রুশ স্থগিত সম্পদ বিনিয়োগ করা হবে। এর ৫০ শতাংশ লাভ পাবে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপও আরও ১০০ বিলিয়ন ডলার যোগ করবে ও ইউরোপে স্থগিত রুশ তহবিল মুক্ত করা হবে। বাকি রুশ তহবিল যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া যৌথ বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্মে যাবে।

১৫. নিরাপত্তা বিষয়ক সব ধারার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে মার্কিন-রুশ যৌথ কর্মদল গঠন হবে।

১৬. রাশিয়া ইউক্রেন ও ইউরোপের বিরুদ্ধে অ-আগ্রাসন নীতি আইনে অন্তর্ভুক্ত করবে।

১৭. যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিস্তার রোধসংক্রান্ত চুক্তিগুলোর মেয়াদ বাড়াতে সম্মত হবে, যার মধ্যে স্টার্ট-১ রয়েছে। নিউ স্টার্ট চুক্তি আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া) মধ্যে কৌশলগত আক্রমণাত্মক অস্ত্রের হ্রাস ও সীমাবদ্ধতা সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ছিল স্টার্ট-১।

১৮. ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে এনপিটি অনুযায়ী অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করবে।

১৯. জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক কেন্দ্র আইএইএ পর্যবেক্ষণে চালু করা হবে এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ রাশিয়া ও ইউক্রেন সমানভাবে ভাগ করবে।

২০. শিক্ষা ও সমাজে সহনশীলতা, সংস্কৃতি বোঝাপড়া, বর্ণবাদ দূরীকরণে উভয় দেশ কর্মসূচি নেবে। ইউক্রেন ধর্মীয় সহনশীলতা ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় ইইউ নিয়ম গ্রহণ করবে। গণমাধ্যম ও শিক্ষায় সব বৈষম্য দূর করা হবে।

২১. ক্রিমিয়া, লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ক সহ অঞ্চলগুলিকে কার্যত রাশিয়ান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, যার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও থাকবে। খেরসন এবং জাপোরিঝিয়াকেও কার্যত স্বীকৃতি দেওয়া হবে। রাশিয়া পাঁচটি অঞ্চলের বাইরে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্যান্য অঞ্চল ত্যাগ করবে। ইউক্রেনীয় বাহিনী বর্তমানে দোনেৎস্ক ওব্লাস্টের যে অংশটি নিয়ন্ত্রণ করে সেখান থেকে নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করবে ও এই প্রত্যাহার অঞ্চলটিকে একটি নিরপেক্ষ অসামরিকীকরণমুক্ত বাফার জোন হিসেবে বিবেচনা করা হবে, যা আন্তর্জাতিকভাবে রাশিয়ান ফেডারেশনের অন্তর্গত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। রুশ বাহিনী এই অসামরিকীকরণমুক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করবে না।

২২. ভবিষ্যৎ সীমান্তব্যবস্থা নিয়ে দুই দেশ জোর করে কোনো পরিবর্তন আনবে না। নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

২৩. রাশিয়া দিনিপার নদী ব্যবহার ও কৃষ্ণসাগর দিয়ে শস্য পরিবহনে ইউক্রেনকে বাধা দেবে না ও এ সংক্রান্ত চুক্তি হবে।

২৪. অবশিষ্ট যুদ্ধবন্দি, মরদেহ, আটক বেসামরিক লোকজন, জিম্মি ও পরিবার পুনর্মিলন সংক্রান্ত সব বিষয়ে কাজ করতে একটি মানবিক কমিটি গঠন করা হবে।

২৫. ইউক্রেন ১০০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে।

২৬. যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ পূর্ণ সাধারণ ক্ষমা পাবে ও ভবিষ্যতে কেউ কোনো অভিযোগ উত্থাপন করবে না।

২৭. এই চুক্তি আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করবে। বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবে শান্তি পরিষদ, যার প্রধান থাকবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। লঙ্ঘনের জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকবে।

২৮. সব পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছালে ও রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তি কার্যকরের প্রকিয়া শুরু করতে রাজি হওয়া পয়েন্টগুলোতে রাজি হলে যুদ্ধবিরতি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে।