চীনের সঙ্গে ক্রমশ উত্তেজনা তীব্র হচ্ছে ভারতের। হিমালয়ের পাদদেশে ব্রহ্মপুত্র নদে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাষ্ট্রটি, যা নয়াদিল্লির মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে চিরশত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়েও চরম উৎকণ্ঠায় আছে দেশটি। আঞ্চলিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই প্রতিবেশী তবে শত্রু রাষ্ট্রগুলোকে প্রতিহতের পদক্ষেপ নিচ্ছে নয়াদিল্লি।
চীনের রক্তচক্ষুকে এবার পাল্টা চ্যালেঞ্জ করতে দক্ষিণ-পূর্ব লাদাখের মুধ-নিওমায় দেশের সর্ববৃহৎ বিমানঘাঁটি নির্মাণ করছে ভারত। চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ও কার্যকর হচ্ছে কমিউনিস্ট সীমান্ত ঘেঁষা এই বিমানঘাঁটিটি।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩ হাজার ৭০০ ফুট উচ্চতায় নির্মিত ঘাঁটিটি সীমান্তের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) সবচেয়ে কাছের অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড (এএলজি)। এই ঘাঁটি থেকে নিয়মিত ওঠানামা করতে পারবে ভারতের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান সুখোই-৩০ এমকেআই, রাফাল কিংবা তেজস।
পাশাপাশি, সেনা পরিবহনকারী সি-১৩০জে ও এন-৩২-এর মতো বিমানও নিয়মিত চলাচল করতে পারবে।
রোববার (২০ জুলাই) ইন্ডিয়া ডিফেন্স রিসার্চ উইং জানিয়েছে, সীমান্তে সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে এর কৌশলগত অবস্থান ভারতীয় বিমানবাহিনীর (আইএএফ) জন্য বাড়তি সুবিধা এনে দেবে। বিশেষ করে লাদাখের মতো দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকায় দ্রুত সৈন্য মোতায়েন, অস্ত্র ও গোলাবারুদের জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ঘাঁটির গুরুত্ব অপরিসীম।

এলএসি থেকে মাত্র ৪৬ কিলোমিটার দূরে নবনির্মিত নিওমা ঘাঁটিতে রয়েছে ২.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রানওয়ে, যা জরুরি অবস্থায় যেকোনো ধরনের সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে।
২০২১ সালে অনুমোদন পাওয়া এই প্রকল্পের মোট বাজেট ছিল প্রায় ২১৪ কোটি টাকা। এএলসি-এর এত কাছে একটি শক্তিশালী বিমানঘাঁটির উপস্থিতি চীনের জন্য স্পষ্ট বার্তা সীমান্ত রক্ষা ও প্রতিরোধে ভারত প্রস্তুত। এই বিমানঘাঁটিটি কেবল যুদ্ধবিমান ওঠানামার জন্যই নয়, বরং ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণ কাজেও ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানে রাডার স্টেশন বসানো, বিমানবাহিনীর (আইএএফ) সদস্যদের জন্য আবাসন তৈরি এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে তোলার কাজ চলছে।
সিন্ধু নদীর তীরে লেহ জেলা থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত নিওমা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যেতে পারে, ফলে প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্য বিশেষ উপযোগী অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এক প্রতিবেদনে দ্য ট্রিবিউন জানায়, নির্মাণ শেষ হলে নিওমা হবে লাদাখে ভারতের চতুর্থ কার্যকর এবং সর্ববৃহৎ (সদর দপ্তর) বিমানঘাঁটি। এর আগে লেহ ইতোমধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ অপারেশনাল বেস হিসেবে কাজ করছে, পাশাপাশি কার্গিল ও থোইস (সিয়াচেনের ঘাঁটি)–এও পূর্ণাঙ্গ বিমানঘাঁটি রয়েছে।
এ ছাড়াও, দৌলত বেগ ওল্ডিতে একটি কাঁচা রানওয়ে রয়েছে, যা বিশেষ অভিযানে ব্যবহার করা হয়। এলএসি থেকে মাত্র ২-৩ কিলোমিটার দূরে ফুকচে ও চুশুলে আরও দুটি রানওয়ে থাকলেও, যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য সেগুলো ততটা কার্যকর নয়।
সীমান্ত সড়ক সংস্থা (বিআরও) গত বছর লাদাখের নিওমায় একটি কাঁচা মাটির রানওয়েকে আধুনিক পাকা রানওয়েতে রূপান্তর করেছে। এলএসি থেকে মাত্র ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই রানওয়েটি এখন সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিআরও-র মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল রঘু শ্রীনিবাসন জানিয়েছেন, ‘অক্টোবরের মধ্যেই বাকি নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে’।
লাদাখের এলএসি বরাবর দুর্গম এলাকাগুলোতে নজরদারি চালানো সবসময়ই বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেখানে পৌঁছাতে হয় কঠিন পথ পেরিয়ে। এতদিন পর্যন্ত ওই এলাকায় কোনো বিমানঘাঁটি না থাকায় কার্যকর নজরদারি করতে পারত না ভারতীয় বিমানবাহিনী। তবে নিওমায় নতুন এয়ারবেস নির্মাণের ফলে এবার স্থলবাহিনীর পাশাপাশি বিমানবাহিনীও সীমান্তে কড়া নজর রাখতে পারবে।

সড়ক অবকাঠামো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রঘু শ্রীনিবাসন আরও বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সীমান্তে এমন কোনো জায়গা থাকবে না, যেখানে আমরা সৈন্য মোতায়েন করতে পারব না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিআরও বর্তমানে উত্তর সেক্টরে দুর্গম সামনের পোস্টগুলোকে সড়কের মাধ্যমে সংযুক্ত করার কাজ করছে, যেখানে এখনো কেবল পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে হয়। আমরা এখন সেই পোস্টগুলোকে রাস্তায় যুক্ত করছি।’
এই উন্নয়ন সীমান্তে সেনাবাহিনীর চলাচল ও লজিস্টিক সরবরাহে বড় ধরনের সুবিধা এনে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০২০ সালে পূর্ব লাদাখে আগ্রাসী মনোভাব দেখায় চীন। এলএসি বরাবর বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে বেইজিং। পাল্টা জবাবে নয়াদিল্লিও রাতারাতি সীমান্তে সেনা মোতায়েন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। অনেক জায়গায় ভারতীয় সেনা ও চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) একেবারে মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মাঝেই মুধ ও নিওমায় বিমানঘাঁটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার।

সীমান্তের এত কাছে বিমানঘাঁটি তৈরিতে চীন প্রকাশ্যে আপত্তি জানালেও ভারতের পক্ষ থেকে সেই চাপ উপেক্ষা করে দ্রুত গতিতে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে পূর্ব লাদাখের দেমচোক ও দেপসাং সমভূমিতে সাম্প্রতিক ভারত-চীন সেনা বিচ্ছিন্নতার (ডিসএনগেজমেন্ট) পর নিওমার কৌশলগত গুরুত্ব আরও বেড়েছে।
যদিও ওই এলাকাগুলোতে সেনা টহল ফের শুরু হয়েছে, তবে সংকট দেখা দিলে এই বিমানঘাঁটি থেকে উচ্চভূমিতে দ্রুত সেনা ও অস্ত্র পাঠানো অনেক সহজ হয়ে যাবে। ২০১০ সালে একটি এএন-৩২ পরিবহন বিমান সফলভাবে নিওমায় অবতরণ করায় আইএএফ তখনই এই ঘাঁটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিমান ঘাঁটিতে রূপান্তরের প্রস্তাব দেয়।
সম্প্রতি চীনের সঙ্গে ৩ হাজার ৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বিতর্কিত সীমান্তজুড়ে উত্তেজনা বাড়ার প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে, বেইজিং তার প্রায় সব সীমান্তবর্তী বিমানঘাঁটি উন্নত করেছে—দীর্ঘ রানওয়ে ও শক্তিশালী বিমান আশ্রয়কেন্দ্রসহ। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লিও এলএসি’র কাছাকাছি বিমানঘাঁটিগুলোর উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করে বলে একাধিক ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর।
আপনার মতামত লিখুন :