ঢাকা রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫

আমেরিকার যেসব ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে ইরান

ওয়াশিংটন পোস্ট
প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২৫, ১২:১৮ এএম
কাতারের দোহার কাছে আল-উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভাষণ দিচ্ছেন। ছবি- সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ওপর সামরিক হামলার কথা ভাবছেন। এর জবাবে তেহরান স্পষ্ট করে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যদি যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ চালায়, তাহলে তারা দ্রুত ও কঠোর প্রতিশোধ নেবে।

চলতি মাসের শুরুতে ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদেহ বলেন, ‘সব মার্কিন ঘাঁটি আমাদের নিশানায় রয়েছে, আর আমরা সাহসের সঙ্গেই পাল্টা আঘাত করব’।

এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য ও আশপাশের এলাকায় থাকা যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি ও সেনা মোতায়েন রয়েছে, যেগুলো ইরান হামলায় অংশ নিতে পারে। একইসঙ্গে, এসব ঘাঁটিই ইরানের সম্ভাব্য প্রতিশোধের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি এখন টানটান। যুদ্ধ শুরু হলে কোথায় কী ঘটবে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। ইরানে হামলা পরবর্তী বড় শঙ্কার মধ্যে রয়েছে এই অঞ্চলের মার্কিন ঘাঁটিগুলো।

গত বুধবার ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেছেন, ‘এই সংঘাতে সামরিকভাবে প্রবেশ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তা অবশ্যই অপূরণীয় হবে।’

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। ছবি- সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৬০ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে।

ইরাকের বাগদাদ থেকে ১৫০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত আল-আসাদ বিমানঘাঁটি দেশটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন ঘাঁটি। এটি ইরাকি ও মার্কিন বাহিনী যৌথভাবে পরিচালনা করে এবং এখানে হাজার হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। এটি বর্তমানে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। ইরান ও এর মিত্ররা বিগত কয়েক বছরে বারবার এই ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করলে, তার জবাবে তেহরান আল-আসাদ ঘাঁটিতে ১৬টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যার ১১টি সরাসরি ঘাঁটিতে আঘাত হানে। এতে বেশ কয়েকজন মার্কিন সেনা আহত হন এবং ঘাঁটির বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়।

ইরান এই হামলাকে ‘প্রতিশোধমূলক’ এবং ‘হত্যার উদ্দেশ্যে’ পরিচালিত বলে জানায়। একই সময় ইরান ‘উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলের ইরবিলের একটি ঘাঁটিতেও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।

এদিকে চলতি মাসেই সিরিয়ায় মার্কিন সেনাবাহিনীর ঘাঁটি সংখ্যা আটটি থেকে কমিয়ে একটি করার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। সেই একমাত্র ঘাঁটি হলো দক্ষিণ সিরিয়ার তানফ, যা ইরাক ও জর্ডান সীমান্তের কাছে অবস্থিত। তবে কখন এই পরিবর্তন কার্যকর হবে তা স্পষ্ট নয়।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তানফ থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে জর্ডানের টাওয়ার-২২ ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালিয়ে তিন মার্কিন সেনাকে হত্যা করা হয় এবং আরও কয়েক ডজন আহত হয়, যা ছিল ২০২১ সালে আফগানিস্তানের কাবুল পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সবচেয়ে বড় হামলা।

পারস্য উপসাগরেও যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত অবস্থান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাহরাইনের মার্কিন নৌ ঘাঁটি, যেখানে ৫ম নৌবহরের সদর দপ্তর এবং প্রায় ৮ হাজার ৩০০ মার্কিন নাবিক মোতায়েন রয়েছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হলো কাতারের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটি, যা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। দোহা শহর থেকে ২০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই ঘাঁটিতে ১০ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা অবস্থান করতে পারে এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) অগ্রবর্তী নিয়ন্ত্রণ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ডিয়েগো গার্সিয়ার মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে বি-২ স্পিরিট বোমারু বিমান। ছবি- সংগৃহীত

পারস্য উপসাগরজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কুয়েতের ক্যাম্প বুহরিং এবং আলী আল-সালেম বিমানঘাঁটি। আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল-ধাফরা বিমানঘাঁটি, যেখানে মার্কিন বিমান বাহিনীর ৩৮০তম বিমান অভিযান ইউনিট মোতায়েন আছে।

এই সপ্তাহে ইরানি কর্মকর্তারা কাতার সরকারকে সতর্ক করে বলেছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালায়, তবে উপসাগরের এসব মার্কিন ঘাঁটি ‘বৈধ লক্ষ্যবস্তু’ হবে। বিষয়টি এক ইউরোপীয় কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এই তথ্য দেন।

শুধু সামরিক ঘাঁটি নয়, এই অঞ্চলের মার্কিন দূতাবাস ও কূটনৈতিক কার্যালয়গুলোও হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ইরাক ও ইসরায়েলে নিজেদের মিশন থেকে কিছু কর্মী ও তাদের পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে।

এছাড়া, ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইরাক-ভিত্তিক শিয়া গোষ্ঠী কাতাইব হিজবুল্লাহর এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবু আলী আল-আসকারি বৃহস্পতিবার বলেন, ‘পুরো অঞ্চলজুড়ে আমেরিকান ঘাঁটিগুলো এখন হাঁস-শিকার করার জায়গায় পরিণত হবে। আকাশে তাদের বিমানের জন্য যে বিস্ময় অপেক্ষা করছে, সেটা তো বলাই হয়নি।’

ইরানের সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে পেন্টাগনের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন পোস্ট–কে জানানো হয়, প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ এর আগেই তার এক্স অ্যাকাউন্টে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। তিনি সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে আমরা অতিরিক্ত সামরিক শক্তি মোতায়েন করছি।’

এর উদ্দেশ্য হলো, ‘এই অঞ্চলে আমাদের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান আরও শক্তিশালী করা, কারণ মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

এদিন পেন্টাগনের মুখপাত্র শন পার্নেল জানিয়েছেন, ‘আমাদের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’

এদিকে বুধবার রাতে নিরাপত্তাজনিত কারণে এয়ার ফ্রান্স ও কেএলএম দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফ্লাইট বাতিল করেছে। তারা জানিয়েছে, ‘এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে’ এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে কবে থেকে আবার ফ্লাইট চালু হবে, তা এখনো জানানো হয়নি।

ইরান কী যুক্তরাষ্ট্রে হামলা করতে পারে?

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) তথ্য অনুযায়ী, ইরানের কাছে অনেক ধরনের ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থাকলেও এখনো তাদের কোনো ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছাতে সক্ষম নয়।

এছাড়া, ইরানের বিমান বাহিনীরও যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত পৌঁছানোর মতো পাল্লা নেই।

তাই, মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলোর ওপর ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলাই এখন যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্বেগ।

দূর থেকে হামলা চালাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র

ইরানের আশেপাশে থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলোর কিছু অংশ সরাসরি হামলায় অংশ নিলেও, মূল আক্রমণ দূর থেকে বিশেষ করে ভারত মহাসাগর বা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই অবস্থিত ঘাঁটি থেকে পরিচালিত হতে পারে।

বিমান বাহিনী বলছে, বি-২ স্পিরিট স্টিলথ বোমারু বিমান, যা ইরানের ভূগর্ভস্থ ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানতে সক্ষম একমাত্র মার্কিন যুদ্ধবিমান। এই বিমানগুলো একটানা ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে উড়ে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসে, মাঝপথে আকাশেই জ্বালানি নেয়। বি-২ বোমারু যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির হোয়াইটম্যান বিমান ঘাঁটি থেকে পরিচালিত হয়।

ফ্লাইটরাডার টুয়েন্টিফোর ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রোববার যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে অন্তত ৩০টি জ্বালানি সরবরাহকারী বিমান পাঠিয়েছে, যা বড় ধরনের বিমান অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয়।

ভারত মহাসাগরের প্রত্যন্ত প্রবালপ্রাচীরের উপর অবস্থিত ব্রিটেনের মালিকানাধীন এবং মার্কিন ও ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যৌথ পরিচালনায় নির্মিত নৌ সহায়তা কেন্দ্র ডিয়েগো গার্সিয়া থেকেও আক্রমণ চালানো হতে পারে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, বি-২ বোমারু বিমান পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ডিয়েগো গার্সিয়া থেকে ইরানে পৌঁছাতে পারে। ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলা চালানোর জন্য মার্কিন সামরিক বাহিনী এই প্রবালপ্রাচীর ব্যবহার করেছে।

প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা এই সপ্তাহে মার্কিন নৌ ইনস্টিটিউটকে জানিয়েছেন, পেন্টাগন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিৎজকে মধ্যপ্রাচ্যে পুনর্নির্দেশ করেছে, এই অঞ্চলে দ্বিতীয় মার্কিন বিমানবাহী রণতরী হিসেবে ইউএসএস কার্ল ভিনসনের সঙ্গে যোগ দিতে।

সব মিলিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র এখন দূরপাল্লার হামলার সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।