ঢাকা রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫

দ্রুজ নেতা হিকমাতের সঙ্গে বাশার আল-আসাদের কী সম্পর্ক?

বিবিসি
প্রকাশিত: জুলাই ২০, ২০২৫, ০৬:২৭ পিএম
দ্রুজ আধ্যাত্মিক নেতা হিকমত আল হিজরি। ছবি- সংগৃহীত

সম্প্রতি সিরিয়ায় ‘ইসরায়েলে’র বোমা হামলার ঘটনা দেশটির ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী দ্রুজ সম্প্রদায় বিশেষ করে তাদের আধ্যাত্মিক নেতা হিকমত আল হিজরির প্রসঙ্গ নতুন করে মানুষের মনোযোগ কেড়েছে। ‘ইসরায়েলে’র প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সিরিয়ার ওপর তাদের হামলাকে বৈধতা দিতে গিয়ে বলেছে, তারা ইসলাম ধর্মের এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ‘রক্ষা’ করতে হামলা চালিয়েছে।

দ্রুজরা হলো সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ। আপাতত, লক্ষ্য পূরণ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, কারণ সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা বৃহস্পতিবার বলেছেন যে দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করা তার সরকারের ‘প্রাধান্য’।

সিরিয়ার এই সম্প্রদায়টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধের শিকার হয়েছে বলে সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে আল-শারা বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত করছি যে তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের প্রধান অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি’।

এ কথার প্রমাণ হিসেবে তার সৈন্য এবং বেদুইন সুন্নি গোষ্ঠীগুলোকে সুয়েদা শহর থেকে সরিয়ে নেয়ার কথা জানান। সুয়েদা হলো দ্রুজ সম্প্রদায়ের ঘাঁটি।

পর্যবেক্ষণ সংস্থার তথ্য অনুসারে, সম্প্রতি সুয়েদা শহরে সহিংস সাম্প্রদায়িক সংঘাত সংঘর্ষ হয়েছে। এসব সংঘর্ষে প্রায় ৬০০ জন নিহত হয়েছেন বলেও জানা গেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে, বিশেষ করে হিকমাত আল হিজরির সঙ্গে একটি চুক্তির পর সুয়েদা থেকে সিরিয়ান বাহিনীকে সরিয়ে নেয়া হয়।

গত কয়েক মাসে তিনি দামেস্ক সরকারের অন্যতম কঠোর সমালোচক হয়ে উঠেছেন এবং তিনি দেশের অন্যতম প্রভাবশালী কণ্ঠস্বরও বটে।

তবে আল হিজরি সব ধরনের চুক্তির কথা অস্বীকার করেছেন এবং সরকারি বাহিনীগুলোকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, “আমাদের প্রদেশকে ‘এই দস্যুদের’ থেকে পুরোপুরি মুক্ত না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।”

ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে

দ্রুজদের আধ্যাত্মিক নেতা আল হিজরির সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিবিসি অ্যারাবিক সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, দ্রুজদের আধ্যাত্মিক নেতা আল হিজরির জন্ম ১৯৬৫ সালের ৯ জুন ভেনেজুয়েলায়। তার বাবা সালমান আহমেদ আল-হিজরি সেসময় ভেনেজুয়েলায় কাজ করতেন। তিনি নিজেও একজন দ্রুজ নেতা ছিলেন।

কিশোর বয়সে তিনি তার পরিবারসহ সিরিয়ায় ফিরে এসে সেখানেই পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়েন। দ্রুজ সম্প্রদায়েরর ওয়েবসাইট আল আমামা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এর তিন বছর পর আল হিজরি কাজের জন্য আবার ভেনেজুয়েলায় ফিরে যান। পরে ১৯৯৮ সালে তিনি স্থায়ীভাবে সুয়েদায় ফিরে আসেন এবং পাশের দ্রুজ আধ্যাত্মিক শহর কানাওয়াতে বসবাস শুরু করেন।

জর্ডানে পরিচালিত ও জার্মান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত নিউজ ওয়েবসাইট সিরিয়া ডাইরেক্ট এমনটাই জানায়।

রক্ষণশীল ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠা আজকের এই শেখ বা ধর্মীয় নেতা দ্রুজ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে ধাপে ধাপে উপরে উঠতে থাকেন। তার ভাই আহমেদের মৃত্যুর পর ২০১২ সালে অবশেষে আল হিজরি মরহুমের স্থলাভিষিক্ত হন। আহমেদ এক রহস্যজনক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন।

বিবিসি মুন্ডোকে ভেনেজুয়েলার সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য আদেল এল জাবায়ার বলেছেন, ‘আল হিজরি তার প্রয়াত ভাইয়ের মতোই, ভেনেজুয়েলার পাসপোর্ট রয়েছে এবং তিনি সেই বিপুল সংখ্যক দ্রুজ বংশোদ্ভূত ভেনেজুয়েলাবাসীর অংশ, যাদের একজন আমি নিজেও।’

সরকারের মিত্র থেকে সমালোচকে পরিণত

হিকমত আল হিজরি ২০১২ সাল থেকে দ্রুজদের আধ্যাত্মিক নেতা, তিনি ক্ষমতাচ্যুত বাশার আল আসাদের শাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থান রেখেছিলেন বলে বিবিসি’র অ্যারাবিক সার্ভিসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সিরিয়া ডাইরেক্ট-এর রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ২০১২ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘বাশার, তুমি জাতির আশা, আরব ঐক্যের আশা এবং আরবদের আশার প্রতীক।’ 

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন এই ধর্মীয় নেতা দ্রুজদের অস্ত্র তুলে নিয়ে আসাদের শাসন ব্যবস্থার পক্ষে লড়াইয়ে নামার আহ্বান জানান। তবে, ২০২১ সালে সিরিয়ান সেনাবাহিনীর এক জেনারেলের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপের পর থেকে ক্ষমতাচ্যুত শাসকের সঙ্গে আল হিজরির সম্পর্কে বিভেদ ও দূরত্ব তৈরি হয়।

আল-হিজরি একে ‘মৌখিক অপমান’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন এবং এর জেরে সুইদায় ব্যাপক বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়, যা কঠোরভাবে দমন করে তৎকালীন সরকার। তার একসময়ের মিত্রকে হঠাৎ করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর, এই শেখ নতুন সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানান, যারা ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল শাম (এইচটিএস) দ্বারা পরিচালিত।

বাশার আল-আসাদ। ছবি- সংগৃহীত

তবে, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় একের পর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সিরিয়ার নতুন শাসকগোষ্ঠী ও দ্রুজ নেতা হিকমত আল হিজরির মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে আল-হিজরি বলেছিলেন, ‘দামেস্কের সরকারের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়া বা চুক্তি নেই’।

তিনি বর্তমান সিরীয় সরকারকে ‘পুরোপুরি চরমপন্থী’ এবং ‘আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে অপরাধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি তখন মন্তব্য করেছিলেন, ‘নিরপরাধ মানুষদের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞ ইসলামিক স্টেট আইএস-এর বর্বরতার কথাই মনে করিয়ে দেয়’।

এই আধ্যাত্মিক নেতার অবস্থান পরিবর্তন ও কিছু আচরণ দ্রুজ সম্প্রদায়ের কিছু অংশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।

সিরিয়া ডাইরেক্টের সামনে অভিযোগ তোলেন সাংবাদিক সামের আল ফারেস, ‘যদিও তিনি বিশ্বাস করতেন যে আসাদ সরকার তার ভাইকে হত্যা করেছে, তবু তিনি সেই সরকারকে সমর্থন করেছেন, তাদের আদেশ মান্য করেছেন এবং তারা যে গণহত্যা ও ধর্ষণ করেছে তার প্রতিবাদ করেননি’।

ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সম্পর্ক

আল হিজরির ঘটনা এমন বহু ঘটনার মধ্যে একটি মাত্র। কারণ ১৯ শতকের শেষ দিকে এবং বিংশ শতকের বেশ কিছু সময় পর্যন্ত হাজার হাজার দ্রুজ সিরীয় ও লেবানিজদের সঙ্গে ভেনেজুয়েলায় চলে আসেন সেখানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখে। এল জাবায়ার বলেছেন, ‘আমার বাবা ১৯৫০-এর দশকে ভেনেজুয়েলায় আসেন অর্থনৈতিক কারণে। যেমনটা হাজার হাজার ইতালিয়ান, পর্তুগিজ এবং দক্ষিণ ইউরোপীয়রা এসেছিল।’

ভেনেজুয়েলার শাসক দল ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ ভেনেজুয়েলার সাবেক এই আইনপ্রণেতা আরও বলেন, ‘বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব দেশে দারিদ্রের দুর্দশা নেমে এসেছিল, সেখান থেকে বহু মানুষ পালিয়ে এসেছিল ভেনেজুয়েলায়’।

ভেনেজুয়েলার আরব ফেডারেশনের সভাপতি এল জাবায়ার বলেন, ‘তিনি (বাবা) ছিলেন একজন কৃষক, আর তখন সিরিয়ার পরিস্থিতি খুব অস্থির ছিল, কারণ প্রায়ই সামরিক অভ্যুত্থান হতো আর অর্থনীতি ভালো চলছিল না। অন্যদিকে, ভেনেজুয়েলায় ছিলো সমৃদ্ধি আর স্থিতিশীলতা।’

তবে, প্রাক্তন চাভিস্তা কংগ্রেসম্যান স্বীকার করেছেন যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে দ্রুজরা দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে অভিবাসী হয়ে আসেনি। পরিশেষে তিনি বলেন, ‘ভেনেজুয়েলার আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হল এটি এমন একটি দেশ যেখানে কোনও ধর্মীয় সংঘাত হয়নি। এখানে সবাইকে হাত মেলে স্বাগত জানানো হতো।’

ইতিহাস থেকে জানা যায় সিরিয়ায় দ্রুজরা অনেক সময় অন্য ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর হাতে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে।

ভেনেজুয়েলায় অভিবাসন শুরু হওয়ার আগে ধারণা করা হতো সিরিয়ায় তিন থেকে পাঁচ লাখ দ্রুজ বা তাদের বংশধর আছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে দ্রুজদের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। দেশটির রাজধানী কারাকাস ছাড়াও, তেলসমৃদ্ধ এলাকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপ মার্গারিটা ছিল এমন কিছু এলাকা যেখানে বিপুল সংখ্যায় দ্রুজ সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করতো।

১৯৯৯ সালে উগো চাভেজের সরকারে আসার পরপরই, দ্রুজ সম্প্রদায়ের সদস্যরা ভেনেজুয়েলায় ক্ষমতার অবস্থানে উঠে আসেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো এল আইসামি পরিবার।

উগো চাভেজের শাসনামলে তারেক এল আইসামি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গভর্নর, পরে নিকোলাস মাদুরোর অধীনে তিনি ভেনেজুয়েলার পেট্রোলিয়াম কোম্পানি ‘পেট্রোলিওস ডি ভেনেজুয়েলা’ (পিডিভিএসএ)-এর প্রেসিডেন্ট ও অর্থনীতির ভাইস প্রেসিডেন্ট হন।

আজ তিনি দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে আছেন।

তার বোন হাইফা ছিলেন সরকারি প্রসিকিউটর ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে-আইসিসি'র ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রদূত। দ্রুজদের প্রভাব যেমন ভেনেজুয়েলায় রয়েছে, তেমনি ভেনেজুয়েলার প্রভাবও সিরিয়ায় আছে। এর একটি প্রমাণ হলো সুয়েদা শহরকে ডাকা হয় ‘লিটল (ক্ষুদে) ভেনেজুয়েলা’ বা ‘সুয়েদাজুয়েলা’ নামে।

এল জাবায়ার বলেছেন, ‘সুয়েদার প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের ভেনেজুয়েলা বংশোদ্ভূত’। তিনি আরও জানান, সেখানে অনেক দোকান আছে যেখানে ভেনেজুয়েলার খাবার বা পণ্য পাওয়া যায়।

২০০৯ সালে সিরিয়া সফরের সময় উগো চাভেজ দ্রুজদের শহর সুয়েদা সফর করেন। তখনকার এই বলিভারপন্থী নেতা বলেন, ‘আমি সুয়েদাকে নিজের ঘর মনে করি। সুয়েদা ভেনেজুয়েলার মতো, সিরিয়া ভেনেজুয়েলার মতো, আর তোমরা জানো, ভেনেজুয়েলা হচ্ছে সিরিয়ার ঘর ও বোন’।