কাতারের রাজধানী দোহায় হামাস নেতাদের ওপর ইসরায়েলি হামলার পর আরব রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো মিলে ন্যাটোর আদলে একটি আরব প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেয় ইরাক। দোহা শীর্ষ সম্মেলনে অন্য রাষ্ট্রগুলো থেকে ইতিবাচক সাড়াও মেলে। কিন্তু বাধ সাধল খোদ আক্রান্ত রাষ্ট্রই। ঐতিহাসিক ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) মিশরের একটি কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানায় মিডল ইস্ট আই। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ওই জ্যেষ্ঠ মিশরীয় কূটনৈতিকের দাবি, এই বাধা আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং ইসরায়েলি হুমকি নিয়ে গঠিত গভীর বিভাজন প্রকাশ করছে।
তিনি জানান, ১৯৫০ সালের যৌথ প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তির অধীনে মিশর একটি দ্রুত-প্রতিক্রিয়াশীল আঞ্চলিক বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেয়, যাতে সদস্য দেশগুলো বহিরাগত হুমকি, বিশেষ করে ইসরায়েল থেকে রক্ষা পায়। তবে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত মূলত এই পরিকল্পনাটি আটকে দিয়েছে। মিশরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলাত্তি উপসাগরীয় প্রতিপক্ষের কাছে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন, যা মূলত বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর না করে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ছিল।
প্রধান মতবিরোধ ছিল নেতৃত্ব নিয়ে। সৌদি আরব নেতৃত্ব নিতে চেয়েছিল। অন্যদিকে মিশর যুক্তি দেয় যে, দীর্ঘ সামরিক অভিজ্ঞতার কারণে তাদেরই নেতৃত্ব দেওয়া উচিত। এর কদিন বাদেই সৌদি আরব পাকিস্তানের সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্রধারী পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার প্রভাব ও ইসরায়েলি হুমকির মধ্যে নতুন উদ্বেগ তৈরি করে।
কূটনীতিকরা জানান, উপসাগরীয় দেশগুলো ইরান বা তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বিষয়টি নিজেদের প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ‘গভীরভাবে হতাশ’ হয়ে দোহা ত্যাগ করেছেন। কাতারি, সৌদি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিডল ইস্ট আই-কে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
১৫ সেপ্টেম্বরের শীর্ষ সম্মেলনে আরব লীগ এবং ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) অংশ নেয়। ইসরায়েলের হামলায় গাজায় ছয়জন নিহত হওয়ার কয়েকদিন পরে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ায় বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের মধ্যে অসন্তুষ্টি তৈরি হয়। মিশর আশা করেছিল, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা ও উত্তর সিনাইয়ে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তবে শীর্ষ সম্মেলনের ফলে মার্কিন প্রভাব বড় ভূমিকা রাখে। কাতারি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র থেকে বার্তা নিয়ে আসে, যেখানে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত নয়। আমেরিকানরা প্রতিশ্রুতি দেয় যে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে উপসাগরীয় অঞ্চলে একই ধরনের আক্রমণ থেকে বিরত রাখবেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতও এই অবস্থান সমর্থন করে।
ফলস্বরূপ, আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভাজন আরও প্রকট হয়। শীর্ষ সম্মেলনের চূড়ান্ত বিবৃতিতে কেবল দোহার ওপর ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মিশরের জন্য এটি আঞ্চলিক জোটে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরি করেছে।
একজন বিশিষ্ট বিশ্লেষক বলেন, প্রেসিডেন্ট সিসি প্রথমবারের মতো ইসরায়েলকে ‘শত্রু’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এটি মিশরের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও ইসরায়েলি হুমকির প্রেক্ষাপটকে প্রতিফলিত করে। কায়রোতে হামাস নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করার ইসরায়েলের হুমকি এবং উত্তর সিনাইয়ে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতির সম্ভাবনা মিশরকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে।
মিশরের এই প্রতিরক্ষামূলক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ১৯৫০ সালের যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির ধারাবাহিক। চুক্তির লক্ষ্য ছিল আরব রাষ্ট্রগুলোকে একত্র করা, সামরিক কৌশল সমন্বয় এবং আঞ্চলিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করা। তবে সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও জাতীয় অগ্রাধিকারের সংঘাত এই চুক্তির কার্যকারিতা দুর্বল করেছে।
২০১৫ সালে শার্ম আল-শেখে এক শীর্ষ সম্মেলনে মিশর পুনরায় একটি ঐক্যবদ্ধ আরব সামরিক বাহিনী গঠনের চেষ্টা করেছিল। তবে নেতৃত্ব ও তহবিল নিয়ে বিরোধ আবারও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বারবার ব্যর্থতা আরব সামরিক সংহতি অর্জনের দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরে।
১৯৭৯ সালে মিশর ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে প্রথম আরব রাষ্ট্র হিসেবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও জনমত এখনো সমর্থন করে না; মিশরীয়রা এখনো ইসরায়েলকে শত্রু হিসেবে দেখে। ১২ সেপ্টেম্বর মিডল ইস্ট আই একচেটিয়াভাবে জানিয়েছে, মিশর তাদের মাটিতে হামাস নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করার ইসরায়েলি ষড়যন্ত্র উন্মোচিত করেছে এবং তেল আবিবকে সতর্ক করেছে যে, এমন প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হবে। এই নিরাপত্তা প্রকাশ মিশরের প্রতিরক্ষামূলক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ইসরায়েলের সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রমের ওপর উদ্বেগকে আরও বাড়িয়েছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন