৩০০-এরও বেশি লেখক, শিক্ষাবিদ ও জনসাধারণের ব্যক্তিত্ব নিউইয়র্ক টাইমসের মতামত বিভাগে লিকবেন না বলে ঘৈাষণা দিয়েছেন। তারা পত্রিকাটিকে গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার ক্ষেত্রে এর ভূমিকার জন্য দায়ী করার উদ্দেশ্যে এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। তারা তিনটি নির্দিষ্ট দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো লেখা প্রকাশ করবেন না।
নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বর্জনকারীদের মধ্যে রয়েছেন রিমা হাসান, চেলসি ম্যানিং, রাশিদা তালিব, স্যালি রুনি, রূপি কৌর, এলিয়া সুলেইমান, মরিয়ম বারঘুতি, গ্রেটা থানবার্গসহ আরও অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তি।
সমালোচকরা বলছেন, পত্রিকাটি ধারাবাহিকভাবে ফিলিস্তিন-সংক্রান্ত খবর বিকৃত করেছে, যা সাংবাদিকতার নৈতিকতার পরিপন্থি। ফিলিস্তিনি সাংবাদিক হুসাম শাবাত মৃত্যুর কয়েক মাস আগে লিখেছিলেন, ‘ভাষাই গণহত্যাকে ন্যায্যতা দেয়। আজ ২৪৩ দিন পরও আমাদের ওপর বোমা পড়ছে, কারণ নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং পশ্চিমা গণমাধ্যম তা সম্ভব করেছে।’ পরে ইসরায়েল তাকে হত্যা করে।
লেখকরা বলেন, পশ্চিমা সমাজের দায়িত্ব হলো এই অপরাধে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহি করানো। তারা উল্লেখ করেছেন যে গণমাধ্যমও অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের মতো যুদ্ধযন্ত্রের অংশ, যা দোষমুক্তি এবং বিদ্বেষের পরিবেশ তৈরি করে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকা এবং এটি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এবং পররাষ্ট্রনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে। অতীতেও ইরান (১৯৫৩), ইরাক (২০০৩) ও লিবিয়া (২০১১)-এর ইস্যুতে টাইমসের প্রতিবেদন ভুল পথে প্রভাব ফেলেছিল।
লেখকরা অভিযোগ করেছেন, পত্রিকাটি ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মিথ্যা তথ্য পুনর্মুদ্রণ করেছে, কভারেজ পরিবর্তন বা গোপন করেছে এবং সাংবাদিকদের নির্দেশ দিয়েছে ‘হত্যা’, ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বা ‘দখলকৃত অঞ্চল’ শব্দ ব্যবহার না করতে। নিয়োগ নীতিতেও আরব ও মুসলিম বিরোধী পক্ষপাত দেখা যায়। বিপরীতে, ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বক্তব্য ‘তথ্য’ হিসেবে প্রকাশিত হয়, এবং গণহত্যাকে শুধু ‘মতামতের’ বিতর্ক হিসেবে দেখা হয়।
লেখকরা টাইমসের মতামত বিভাগকে ‘ডিনার পার্টি’ হিসেবে বর্ণনা করার বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের মতে, এমন একটি পত্রিকার সঙ্গে সহযোগিতার বিনিময়ে কিছু পরিচিতি পাওয়ার কোনো মূল্য নেই। তারা উল্লেখ করেছেন যে এই বিভাগ মূলত তাদের লেখকদের উপর নির্ভরশীল, এবং এর মাধ্যমে পত্রিকা সুনাম ও মর্যাদা বজায় রাখে।
লেখকদের তিনটি দাবি
দাবি ১- সংবাদ বিভাগকে অবশ্যই ফিলিস্তিনবিরোধী পক্ষপাত পর্যালোচনা করে নতুন সম্পাদকীয় মানদণ্ড প্রণয়ন করতে হবে। বিগত কয়েক দশকের পক্ষপাতমূলক ও বর্ণবাদী সংবাদ কাভারেজ সংশোধনের জন্য টাইমস–কে তাদের স্টাইল গাইড, তথ্য সংগ্রহ ও উদ্ধৃতির পদ্ধতি এবং নিয়োগনীতি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। যারা ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীতে কাজ করেছে, তাদের ইসরায়েলের যুদ্ধসংক্রান্ত প্রতিবেদনে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়া ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে সংগৃহীত তথ্য প্রকাশের প্রচলিত প্রথা বন্ধ করতে হবে।
দাবি ২- সংবাদ বিভাগকে ‘স্ক্রিমস উইদাউট ওয়ার্ডস’ শীর্ষক বিতর্কিত প্রতিবেদনটি প্রত্যাহার করতে হবে। ২০০৪ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস স্বীকার করেছিল যে, ইরাকে তথাকথিত ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ নিয়ে তাদের ভুল প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রের বিপর্যয়কর আক্রমণকে উৎসাহ দিয়েছিল। একইভাবে ‘স্ক্রিমস উইদাউট ওয়ার্ডস’ প্রতিবেদনে ৭ অক্টোবরের ‘অস্ত্র হিসেবে যৌন সহিংসতা’–সংক্রান্ত অপ্রমাণিত দাবি অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে।
প্রতিবেদনের প্রধান গবেষক প্রকাশ্যে গণহত্যার পক্ষে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে লাইক দেওয়ার কারণে চাকরিচ্যুত হন, সাক্ষ্যদাতারা অবিশ্বস্ত প্রমাণিত হয়েছেন এবং যাদের নিয়ে প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছিল, তারা নিজেরাই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এই প্রতিবেদন টাইমস-এর নিজস্ব তথ্যযাচাই মানদণ্ডও পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
দাবি ৩- সম্পাদকীয় বোর্ডকে ইসরায়েলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানাতে হবে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বোর্ড অবশেষে যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নেয়—যা পরে কিছু আইনপ্রণেতা সমর্থন করেন এবং অক্টোবর মাসে তা কার্যকর হয়। কিন্তু ইসরায়েল প্রমাণ করেছে, শুধু যুদ্ধবিরতি গাজার ধ্বংস ঠেকাতে যথেষ্ট নয়। টেকসই শান্তির জন্য অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই সেই অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে, যা ইসরায়েলের অপরাধকে সম্ভব করছে। টাইমস-এর সম্পাদকীয় বোর্ডের উচিত তার প্রভাব ব্যবহার করে এই নিষেধাজ্ঞার পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
তারা বলেছেন, এই দাবিগুলো অযৌক্তিক নয়, এবং অতীতেও জনসাধারণের চাপের ভিত্তিতে টাইমস এর স্টাইল গাইড আপডেট করেছে।
লেখকরা সর্বশেষে উল্লেখ করেছেন, ফিলিস্তিন সংহতি আন্দোলনের তিনটি দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা নিউজরুম বা মতামত বিভাগে কোনো লেখা প্রকাশ করবেন না।
তারা মনে করেন, এভাবেই টাইমসের দীর্ঘদিনের পক্ষপাতদুষ্ট কভারেজ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মিথ্যাচারকে চ্যালেঞ্জ জানানো সম্ভব।

