রবিবার, ২৫ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: মে ২৫, ২০২৫, ০৪:১৩ এএম

১৫ প্রেসের ৪ লাখ বই নিম্নমানের

উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: মে ২৫, ২০২৫, ০৪:১৩ এএম

১৫ প্রেসের ৪ লাখ বই নিম্নমানের

সর্বোচ্চ দর দিয়ে ‘প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই)’ বা মান যাচাইকারী এজেন্ট নিয়োগ করেও চলতি শিক্ষাবর্ষে মানসম্পন্ন বিনা মূল্যের শতভাগ পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের দিতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। 

কাগজের মান যাচাই করে সে অনুযায়ী প্রেসগুলোতে বই ছাপিয়ে সারা দেশে সরবরাহ হচ্ছে কি না, তা তদারক করা পিডিআই এজেন্টের দায়িত্ব।

কিন্তু পিডিআই এজেন্টের ছাড়পত্র নিয়ে ‘অতি নিম্নমানের’ কাগজে ১৫টি প্রেসের বই সারা দেশে সরবরাহ করা হয়েছে বলে এনসিটিবিতে পাঠানো ‘পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন’ (পিএলআই) রিপোর্টে জানানো হয়েছে। নিম্নমানের বইয়ের জন্য সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে কি না, তা যাচাই করে পিএলআই রিপোর্টে প্রেস ও পিডিআই এজেন্টের বিরুদ্ধে তদন্তের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত প্রেসগুলোকে পিএলআই রিপোর্টের বিষয় অবহিত করে জানিয়ে নিম্নমান বইয়ের পরিবর্র্তে সমপরিমাণ মানসম্পন্ন বই অবিলম্বে ‘রিপ্লেস’ করার জন্য বলা হবে।

চলতি শিক্ষাবর্ষে ১১৭টি প্রেস ৭৩২টি লটে মাধ্যমিকের বই ছাপার কাজ করেছে। এরই মধ্যে ৪৪টি প্রেসের ৪৪টি লটের বইয়ের মান নিয়ে রিপোর্ট জমা দিয়েছে পিএলআই এজেন্ট। রিপোর্টে ১৫টি লটের প্রায় ৪ লাখ অতিনিম্নমানের বই বলে জানানো হয়েছে। জমা পড়া মোট লটের মধ্যে ভালো-খারাপ অনুপাতে অতিনিম্নমান রয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। এই অনুপাত হিসাব করে ৭৩২টি লটের রিপোর্ট জমা হওয়ার পর নিম্নমানের বইয়ের সংখ্যা কতটা বাড়তে পারে, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। 

নিম্নমানের বইয়ের অভিযোগ পাওয়ার সতত্য স্বীকার করে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিষয়টি নজরে রয়েছে। বইয়ের সংখ্যা বাড়লে তা অবশ্যই অ্যালার্মিং হবে। তিনি বলেন, যে পরিস্থিতিতে চলতি শিক্ষাবর্ষের বই প্রস্তুত করতে হয়েছে, সেখানে পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তবে যে কোনো মূল্যে মানসম্পন্ন বই দিতে আমাদের জোর চেষ্টা ছিল।

এ বিষয়ে বর্তমানে অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা এনসিটিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, একটা বইও খারাপ যাওয়া দুঃখজনক। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মনে হয়েছে, ভালো দর পেলে ইন্সপেকশন এজেন্টের কাজও ভালো হবে।

এ ছাড়া টেন্ডার বাতিল করে পুনরায় করার মতো সময় ছিল না। এ ছাড়া বই খারাাপের জন্য চেয়ারম্যান একা দায়ী হতে পারেন না। কারণ, এখানে পিডিআই, এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা ও মনিটরিং কর্মকর্তা সবাই ছিলেন।

পিডিআই কোম্পানি ব্যুরো ভেরিতাসের কর্মকর্তা আফজাল কবীর বলেন, এমন হওয়ার কথা নয়। পিডিআই এজেন্টের দায়িত্ব শুধু কাগজ ছাড় ও ফ্যাক্টরির কাজ ইন্সপেকশন করা মন্তব্য করে তিনি বলেন, বই ‘লোডিং সুপারভিশনের দায়িত্ব’ আমাদের নয়। এ ছাড়া ইন্সপেকশন এজেন্ট ‘র‌্যান্ডম সেম্পল’ পদ্ধতিতে কাজ করে।

পাশাপাশি নানা কারণ, বিশেষ করে বিদ্যুতের জন্য কাগজের এক রোলের একটি শিটেও জিএসএমের একাধিক পার্থক্য হতে পারে। এ ছাড়া প্রেসগুলো খারাপ বই দিলে সেগুলো ‘রিপ্লেস’ করার একটি শর্তও দরপত্রে রয়েছে।

জানা গেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৯ কোটি ৫৯ লাখ ৬৬ হাজার কপি বই বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটি ১৯ লাখ ১২ হাজার এবং মাধ্যমিকে ৩০ কোটি ৪০ লাখ ১২ হাজার বই ছিল। 

মাধ্যমিকের বই উৎপাদন ও বিতরণসহ সব কাজ এনসিটিবি নিজস্ব কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পিডিআই-পিএলআই এজেন্ট দিয়ে করায়। অন্যদিকে প্রাথমিক স্তরে পিডিআই-পিএলআইয়ের মাধ্যমে বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ তদারক করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। কিন্তু পিডিআই-পিএলআই উভয় ক্ষেত্রে একই কোম্পানি মান যাচাইয়ের কাজ করায় অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য সঠিক না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

এ কারণে আগামী ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিকের মতো প্রাথমিক স্তরেও পিডিআই-পিএলআই আলাদা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাথমিকের ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপানোর দরপত্রেও বিষয়টি উল্লেখ করা হচ্ছে। পিডিআই-পিএলআই আলাদা কোম্পানির মাধ্যমে করার সিদ্ধান্তে খুশি জানিয়ে এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু বলেন, এতে নিম্নমানের বই চিহ্নিত করা সহজ হবে। 

সূত্রের দাবি, মাধ্যমিক স্তরে বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণের সব দায়িত্ব এনসিটিবির। অথচ পিডিআই এজেন্ট ব্যুরো ভেরিতাসের বইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য সে সময় প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ না থাকা এবং সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়ায় পিপিআর লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলো নজরে আনা হলেও গুরুত্ব দেয়নি এনসিটিবি। 

এখন পিএলআইয়ের রিপোর্টে অভিযোগ আসায় এনসিটিবির সে সময়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কাগজের মান যাচাইবাছাই করে ছাড়পত্র দেওয়া এবং সে অনুযায়ী প্রেসগুলোর ছাপানোর কাজ তদারক করতে পিডিআই ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছার পর বইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য পিএলআই এজেন্ট নিয়োগ দেয় এনসিটিবি।

সাধারণত একই সময়ে খোলা দরপত্রের (ওপেন টেন্ডার মেথড) মাধ্যমে এই ইন্সপেকশন এজেন্টদের এনসিটিবির প্রাক্কলিত দরের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা নিয়োগ পাওয়ার জন্য মনোনীত হন।

উভয় এজেন্টেই তাদের কাজের রিপোর্ট এনসিটিবিতে পাঠায়। চলতি শিক্ষাবর্ষে বইয়ের পিডিআইয়ের কাজ করেছে ‘ব্যুরো ভেরিতাস’। আর বর্তমানে পিএলআইয়ের কাজ করছে হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিস। 

চলতি বছর মাধ্যমিক স্তরের পিডিআই ও পিএলআই এজেন্ট নিয়োগের জন্য গত ৭ নভেম্বর দরপত্র খোলা হয়। পিডিআইয়ের দরপত্রে মোট ছয়টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।

এ কাজের জন্য এনসিটিবির প্রাক্কলিত দর ছিল ৭৫ লাখ টাকা। প্রাক্কলিত দরের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসের দর ছিল ৩ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ ৩২ লাখ ৬১ হাজার ৩৫৫ টাকা দর দিয়ে ব্যুরো ভেরিতাসের অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। দরপত্রে অংশ নিয়ে সবার দরই ছিল এনসিটিবির প্রাক্কলিত দরের মাইনাসে। 

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) অনুযায়ী প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রাপ্ত দর মাইনাসে থাকলে বা টেন্ডারারদের দর নিয়ে কোনো সন্দেহ তৈরি হলে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বিধান লঙ্ঘন করে দরপত্রের তালিকায় ৬ নম্বরে থাকা ব্যুরো ভেরিতাসকে পিডিআইয়ের দায়িত্ব দেয়।

বইয়ের মান যাচাইয়ে প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ না থাকার পরও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এই যুক্তি দিয়ে ওই কোম্পানিকে নিয়োগ দেয় এনসিটিবি। বিষয়টি নিয়ে ওই সময় ‘ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়ে বিতর্কের ঝড়’ শিরোনামে রূপালী বাংলাদেশে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। 

বর্তমানে অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা এনসটিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান রূপালী বাংলাদেশকে বলেছিলেন, মানসম্পন্ন বই পাওয়ার জন্য সর্বোত্তম সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে। তবে ওই সময় ব্যুরো ভেরিতাস পরিদর্শনে যাওয়া এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছিল, বইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় দুটি মেশিন পরিদর্শনের সময় পাওয়া যায়নি।

পিডিআইয়ের সঙ্গে একই সময়ে পিএলআইয়ের দরপত্রেও অংশ নেয় ছয়টি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রাপ্ত দর কম হওয়ায় তা বাতিল করে চলতি বছরের  মার্চ মাসে দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বান করা হয়। সর্বনিম্ন ১৭ লাখ টাকা দর দিয়ে পিএলআইয়ের কাজ পায় বর্তমানে কাজ করা হাই-টেক সার্ভে।

তবে পিডিআইয়ের মতো এবারও দর তুলনামূলক কম এই অজুহাতে তালিকায় ৬ নম্বরে থাকা একটি কোম্পানিকে ২৭ লাখ টাকায় কাজ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ ছিল। 

কিন্তু প্রথমবারের মতো পিপিআর লঙ্ঘন না করার লক্ষ্যে এনসিটিবির কয়েক কর্মকর্তা অটল থাকায় চেষ্টাটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ মে থেকে ২২ মে পর্যন্ত পিএলআই এজেন্ট ৪৪টি প্রেসের ৪৪টি লটের বইয়ের মান সম্পর্কে এনসিটিবিতে প্রতিবেদন জমা দেয়। ২৬টি লটের বই এনসিটিবির দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী মানসম্পন্ন হলেও ১৪টি লটের বই অতি নিম্নমানের বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এই লটগুলোর বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ।  

বিতরণ নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) বরাবর পাঠানো সেই প্রতিবেদনে অভিযুক্ত প্রেসের নাম উল্লেখ করে কাজ পাওয়া লটের নম্বর, বইয়ের সংখ্যা, বইয়ের বিষয় ও কাগজের জিএসএম দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী কম থাকার কথা বলা হয়েছে। 

যেমন একটি প্রেসের বইয়ে ৭০ জিএসএম থাকার শর্ত থাকলেও ছিল ৫৬ জিএসএম। আবার কোনো প্রেসের বইয়ে রয়েছে ৫৯ জিএসএম। এ ছাড়া কাগজের অন্যান্য সূচক যেমনÑ ব্রাইটনেস, বাস্টিং ইত্যাদিও কম থাকায় সার্বিকভাবে বইগুলোকে অতিনিম্নমান বলে উল্লেখ করা হয়।

পিএলআই এজেন্টের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘..........পিডিআই এজেন্ট কর্তৃক ছাড়পত্র প্রদানের পর উক্ত লটের বই সব জেলায় সরবরাহ করে’ এবং আরও বলা হয় ‘......অতিনিম্নমানের পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করে, একই সঙ্গে পিডিআই এজেন্ট কর্তৃক ছাড়পত্র প্রদান করায় এনসিটিবি তথা সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ায়’ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!