দীর্ঘকাল কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর একজন স্বৈরশাসকের মুখ থেকে বের হওয়া একটি বাক্য আর একটি গণআন্দোলন, যা পালটে দিল দেশের ইতিহাস। তুমুল জনবিক্ষোভের মুখে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শক্তিশালী স্বৈরশাসকের দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশেই ২০২৪ সালে ঘটে এ ঐতিহাসিক ঘটনা। এ গণঅভ্যুত্থান ছাত্র, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সংগঠিত হয়েছিল। যার সম্মুখ সারিতে ছিল শিক্ষার্থীরা। সেখানে তরুণদের পাশাপাশি তরুণীদের অংশগ্রহণও ছিল তাৎপর্য এবং সাহসিকতাপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের সঙ্গে সমানতালে ছাত্রীরাও বিক্ষোভ-আন্দোলনের সামনে থেকে দিয়েছেন নেতৃত্ব। নারীরাও রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার হন। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়, অনেকেই পুলিশি হয়রানি ও নির্যাতনের মুখোমুখি হন। কিন্তু তবু তারা থেমে যাননি বরং আরও বেশি সংগঠিত হয়ে উঠেন। এভাবে সবাই মিলে তৈরি করেন এক নতুন বাংলাদেশের।
দুঃখজনক হলেও সত্য, গত এক বছরে নতুন বাংলাদেশ গঠনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা যতটা আলোচনায় এসেছে, পেয়েছে মর্যাদা ঠিক ততটা পাননি ছাত্রীরা। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত হলেও যথেষ্ট মর্যাদার পদ পর্যন্ত পাননি ছাত্রীরা। এমনকি তাদের নবগঠিত রাজনৈতিক দলেও। এটিকে যুগ যুগ ধরে নারীদের পিছিয়ে রাখার মন-মানসিকতাই বলে মনে করছেন নারী নেত্রীরা।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১৩২ শিশু-কিশোর ও ১১ জন নারী শহিদ হন। শহিদ এই ১১ নারীর মধ্যে রয়েছেন মায়া ইসলাম, মেহেরুন নেছা, লিজা, রিতা আক্তার, নাফিসা হোসেন মারওয়া, নাছিমা আক্তার, রিয়া গোপ, কোহিনূর বেগম, সুমাইয়া আক্তার, মোসা. আক্তার ও নাঈমা সুলতানা। শহিদ আবু সাঈদ, মুগ্ধদের নাম যেভাবে উচ্চারিত হয় ক্ষণে ক্ষণে ঠিক ততটাই যেন উপেক্ষিত হয় এসব নারী শহিদ।
২০২৪ সালের জুনে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রথমে ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই এটি সামগ্রিক জনগণের গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ওই বছরের ১৫ এবং ১৬ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্বিবাদ্যালয়ের রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা প্রথম কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেন। হাতিয়ার হিসেবে হাতের কাছে যা ছিলো যেমন, প্লেট এবং চামচ হাতে উচ্চস্বরে স্লোগান দিতে থাকেন। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, একই সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা নেমে আসে রাস্তায়।
শুরুর দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নারীদের মধ্যে নেতৃত্বে আসেন উমামা ফাতেমা। যিনি ছিলেন প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র। আর নুসরাতম তাবাসসুম ছিলেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী। তারা নারীদের প্রতিবাদের দৃঢ় সত্তা ও নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছেন। এর পর আন্দোলনে যোগ দেয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
১৭ জুলাই রাতে ব্র্যাক ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রী, ছাত্রলীগের সদস্যদের হাতে হামলা ও হয়রানিরও শিকার হন, যা নিয়ে দেশজুড়ে তীব্র নিন্দা ওঠে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব নারী শিক্ষার্থী শুধু মিছিলে অংশ নেননি, তারা রেজিস্ট্রেশন, পোস্টার, ফুড ডিসট্রিবিউশন ও মেডিকেল সাপোর্ট টিম গঠন করে সার্বিক সহযোগিতাও করেন।
একটা সময় স্কুলের মেয়েরাও নেমে পড়েন রাস্তায়। বিশেষ করে ভিকারুননিনসা স্কুলের মেয়েরা রাস্তায় নামলে হলিক্রস, ইস্পাহানীসহ রাজধানীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্কুলের মেয়ে শিক্ষার্থীরাও নেমে যোগ দেন সরকার পতনের এক দফা দাবির আন্দোলনে। পরবর্তী সময়ে দেশের বেশির ভাগ জেলার ছাত্রীরাও পথে নামে। আন্দোলন দ্বিগুণভাবে উৎসাহিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাঞ্জিদা আহমেদ টনির ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর। তার রক্তাক্ত ছবিটি যেন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে।
শহিদ আবু সাঈদের মতোই তার ছবিটিও, যা সারা দেশে ক্ষোভ ও সহানুভূতির ঢেউ তোলে। এরপরই আসে নূরজাহানের নাম। পুলিশি আক্রমণের ভয়াবহ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ থেকে পিছিয়ে না গিয়ে দৃঢ় অবস্থানে থেকে সাহসিকতা দেখানো মেয়েটি আন্দোলনে নারীদের সাহসের প্রতীক হয়ে উঠে। ওই সময়টায় শুধু পুলিশ নয়, আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের ছেলেরাও। জীবনের ঝুঁকির কথা মাথায় না রেখে ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বুলেট ও লাঠির মুখোমুখি হন মেয়েরাও।
এত কিছু করেও আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে নারীরা রাজনৈতিক পর্যালোচনা ও পুনর্গঠনে পিছিয়ে পড়েছেন। যেখানে ছাত্র নেতারা সরকারে পর্যন্ত স্থান পেয়েছেন। নারী শিক্ষার্থীদের সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা ও অনাকাঙ্ক্ষিত বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা তাদের আন্দোলনের পরবর্তী ভূমিকা অস্বস্তিতে পরিণত করেছে। যেখানে ছাত্রদের মতোই সমানতালে সাহস, আত্মত্যাগ ও দৃঢ়তায় আন্দোলন সফল করেন তারা।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফৌজিয়া মোসলেম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নারী শিক্ষার্থীদের সম্মান ও স্মৃতিচারণ, আন্দোলনের চিত্র, গল্প ও সংগ্রামের সাক্ষ্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের মানসিক ও আইনি সহায়তা, সামাজিক কলঙ্ক থেকে মুক্তি এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা ও মিডিয়ার ন্যায়সঙ্গত কাভারেজ নারীদের প্রতিবাদের সঠিক ব্যাখ্যা ও স্বীকৃতি প্রদানে সমাজ ও মিডিয়ার ভূমিকা থাকতে হবে।
গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কয়জন নারীর মধ্যে অন্যতম উমামা ফাতেমা। জুলাই আন্দোলনের বারুদ দিনের কথা সামনে এনে তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজপথের প্রতিটি সভা-মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন নারীরা। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে দেশ থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসন চিরতরে মুছে দিতে জীবন বাজি রেখে রাত-দিন রাজপথে ছিলেন আমাদের সংগ্রামী নারীরা। আন্দোলন-সংগ্রামে পাবলিক ও প্রাইভেট-সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমরা কেউ নারী বা পুরুষ পরিচয় নিয়ে তখন মাঠে নামিনি। আমরা দেখছিলাম, একটা দেশের সরকার কীভাবে তার নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করছিল। তাই আমরা পথে নেমেছিলাম।’
আন্দোলনের সেই দিনগুলোয় নারী শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামীমা সুলতানাও। আন্দোলরত শিক্ষার্থীদের হত্যা, নির্যাতন ও আটকের ঘটনায় দায়ী করে ১ আগস্ট নিজ কার্যালয় থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে ফেলে নজির সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। সেই সময়টায় কীভাবে এমনটা করতে পেরেছিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা কোটা আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণকে হত্যা করেছেন, আবার বারবার মিথ্যাচার করেছেন। তার হাতে শিক্ষার্থীদের রক্ত লেগে আছে। শিক্ষার্থীরা আমার সন্তানের মতো। যার হাত আমার সন্তানের রক্তে রঞ্জিত, তার ছবি আমার দেওয়ালে রাখতে চাইনি। মানুষের হৃদয় থেকে তার (শেখ হাসিনা) ছবি মুছে গেছে। তাই তার ছবি দেওয়াল থেকে সরিয়ে ফেলেছিলাম।
আপনার মতামত লিখুন :