সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে লুট হওয়া সাদাপাথর উদ্ধারে গতকাল বুধবার সকাল থেকে অভিযান শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম দায়িত্ব নেওয়ার পরই তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। গত মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার পরদিন থেকে সরাসরি অভিযান চালানো হচ্ছে। এদিকে পর্যটনকেন্দ্র ও রেলওয়ে বাংকার এলাকায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ঘটনায় পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভয়াবহ ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে গণশুনানি আয়োজন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি। তারা এ সময় বিভিন্ন জনের বক্তব্য শোনেন।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, আলটিমেটামের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ঘনফুট পাথর স্বেচ্ছায় ফেরত এসেছে। এ ছাড়া প্রশাসনের উদ্যোগে আরও প্রায় ২৬ লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। প্রশাসনের ধারণা, এখনো অন্তত ৩০ শতাংশ পাথর জমা পড়েনি।
এদিকে উদ্ধারকৃত পাথর পুনঃস্থাপনের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১১ লাখ ঘনফুট পাথর পুনঃস্থাপন হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাকি অংশ শেষ হবে বলে আশা করছে প্রশাসন। এ কাজে প্রতিদিন ৫০০ শ্রমিক, ৪০০ নৌকা আর ৩০০ ট্রাক ব্যবহার হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক সারওয়ার আলম বলেন, ‘সব পাথর পুনঃস্থাপন সম্ভব হলে ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য অনেকটাই ফিরবে। প্রাকৃতিকভাবে যেরকম ছিল, পুরোপুরি তেমন না হলেও আমরা চেষ্টা করছি।’
এদিকে লুটপাটের ঘটনায় এরই মধ্যে সিআইডি তদন্ত শুরু করেছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এ অনুসন্ধান চলছে। সিআইডির প্রাথমিক তথ্যে প্রায় ৫০ জনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে। তাদের তারা হন্য হয়ে খুঁজছে।
এর আগে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীসহ ৫৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনেও শতাধিক ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। এ ছাড়া উচ্চপর্যায়ের আরেকটি তদন্ত কমিটিও কাজ করছে।
তদন্ত কমিটির গণশুনানি: গতকাল সকালে সিলেট সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির গণশুনানি। গণশুনানিতে সভাপতিত্ব করেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) জাহেদা পারভীন। উপস্থিত ছিলেন কমিটির অন্য সদস্যরাও। গণশুনানিতে অংশ নেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। বক্তব্য দেন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ট্রাক পরিবহন মালিক সমিতি, পাথর ব্যবসায়ী সমিতি, পরিবেশবাদী সংগঠন ও সাংবাদিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা, তথ্য ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করেন।
তদন্ত কমিটি গত মঙ্গলবার থেকে সরেজমিন তদন্ত শুরু করে, যার অংশ হিসেবে তারা সাদাপাথর এলাকা পরিদর্শনও করেছে। উল্লেখ্য, ২০ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে এ কমিটি গঠিত হয়।
এর আগে সাদাপাথর লুটপাটসংক্রান্ত একটি বিস্ফোরক প্রতিবেদন জমা দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের অনুসন্ধানে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীসহ ৫২ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসিসহ প্রশাসনের অনেককেই অভিযুক্ত করা হয়েছে। দুদকের পাশাপাশি জেলা প্রশাসন গঠিত আরেকটি তদন্ত কমিটিও প্রতিবেদন দিয়েছে, যেখানে শতাধিক ব্যক্তির জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। তবে নাম প্রকাশ করা হয়নি।
পাথর লুটপাটে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, দায় এড়াতে বিভিন্ন মহলের একে অপরকে দোষারোপ ও দীর্ঘদিন ধরে চলমান অনিয়মের বিষয়টি গণশুনানিতে বারবার উঠে আসে। তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সব তথ্য ও বক্তব্য যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দ্রুত সময়ের মধ্যেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেওয়া হবে।
বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধে জেলা প্রশাসকের আদেশ: সিলেটে বালু-পাথর উত্তোলন নিয়ে এক সরকারি আদেশ জারি করেছেন নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম। গতকাল বুধবার জানা যায়, গত মঙ্গলবার সিলেট জেলা প্রশাসন থেকে সীমান্ত এলাকাসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে বালু-পাথর উত্তোলন কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক তার আদেশে লেখেন, যেহেতু সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন সম্ভাবনাময়; সেসব এলাকা থেকে কতিপয় ব্যক্তি অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন, সংরক্ষণ, পরিবহন, লুণ্ঠন ও পাচারের সাথে জড়িত রয়েছেন এবং যেহেতু প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ-সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেহেতু সিলেট জেলায় অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলন, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণেরও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
পাথর উদ্ধারে চিরুনি অভিযান, একজনকে কারাদ-: প্রশাসনের তিন দিনের আল্টিমেটাম শেষে সিলেটের লুণ্ঠিত পাথর ফেরাতে চিরুনি অভিযান চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরে প্রশাসনের চিরুনি অভিযানে পাথর লুটপাট ও অবৈধ লালপাথর হেফাজতে রাখার অপরাধে একজনকে বিনাশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়েছে। এ সময় অভিযানে ৫ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার জৈন্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। দ-িত ব্যক্তি হলেন, সিলেটের জৈন্তাপুর থানার আসামপাড়া এলাকার মৃত মনির মিয়া ছেলে আব্দুল আলিম (৪২)।
জানা গেছে, অবৈধভাবে উত্তোলিত ও মাটিচাপা দিয়ে লুকানো পাথর শনাক্ত ও উদ্ধার, অবৈধ পাথর ব্যবসায়ী, দখলদার ও সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের সদস্যদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা, উদ্ধার করা পাথরগুলোকে প্রকৃত অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়া এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোর স্বাভাবিক পরিবেশ পুনরুদ্ধার করতে চিরুনি অভিযান শুরু করে সিলেট জেলা প্রশাসন। গতকাল জৈন্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে পাথর লুটপাট ও অবৈধ লালপাথর হেফাজতে রাখার অপরাধে একজনকে বিনাশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়েছে। এ সময় তার কাছ থাকা ৫ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় জেলা প্রশাসন ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সিলেটের জৈন্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ বদরুজ্জামান বলেন, ‘সিলেটের জেলা প্রশাসনের চিরুনি অভিযানে একজনকে বিনাশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়েছে। আসামি এখনও থানা হাজতে আছে। আমরা কালকে (আজ) তাকে কারাগারে প্রেরণ করবো।’
সিলেটের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম বলেন, ‘প্রশাসনের দেওয়া সময়সীমা শেষ হয়েছে। সিলেটের লুণ্ঠিত সাদাপাথর উদ্ধারে প্রশাসনের চিরুনি অভিযান শুরু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, পাথর লুটে জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। যারাই প্রকৃতির ক্ষতি করেছে, তাদের বিচার হবে। আর পাথর প্রতিস্থাপনের কাজ যতটা সম্ভব প্রকৃতির কাছাকাছি রূপে সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন