মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপনে কাজ করছে মহাকাশ সংস্থা, বিজ্ঞানীরা এবং ইলন মাস্কের মতো ধনকুবেররা। তবে, বসতি নির্মাণে প্রয়োজনীয় উপকরণ পৃথিবী থেকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ এর জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ। নাসার একটি রোভার ‘পারসিভারেন্স’ গ্রহে পাঠানোর জন্য এক টন মালামাল পাঠাতে ২৪৩ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। তাই মঙ্গলের মাটি থেকে ধাতু নিষ্কাশনের চিন্তা ছিল বিজ্ঞানীদের। সে পথে অনেকটাই সফল হয়েছেন বলে দাবি তাদের।
বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন ধরেই গবেষণা করছেন সিএসআইআরও পোস্টডক্টোরাল ফেলো এবং সুইনবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ড. দেদি নবাবান। তিনি বলেন, মঙ্গল গ্রহের মাটিকে ‘রেগোলিথ’ বলা হয়। ‘পৃথিবী থেকে ধাতু পাঠানো হয়তো সম্ভব, তবে তা অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়। মঙ্গল গ্রহে ধাতুর টন টন মালামাল পাঠানোর কল্পনা করুন, এটি বাস্তবসম্মত নয়। তাই ইন-সিচু রিসোর্স ইউটিলাইজেশন (আইএসআরইউ) কৌশল ব্যবহার করা প্রয়োজন, অর্থাৎ মঙ্গলের স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করা।
আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, ড. নবাবান ও সুইনবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোমেটালার্জি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আকবর রামধানি মঙ্গল গ্রহের মাটিতে ধাতু উৎপাদন প্রক্রিয়া পরীক্ষা করছেন। তারা এই প্রক্রিয়া পরীক্ষা করতে ব্যবহার করেছেন রেগোলিথ সিমুল্যান্ট, যা মঙ্গলের মাটির কৃত্রিম অনুকরণ।
মঙ্গল গ্রহের মাটিতে প্রয়োজনীয় ধাতু তৈরির উপাদান রয়েছে। যেমনÑ আয়রন-সমৃদ্ধ অক্সাইড এবং মঙ্গলের পাতলা বায়ুম-ল থেকে আসা কার্বন। সুইনবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আকবর রামধানি বলেন, ‘আমরা গ্যাল ক্রেটারের মতো মঙ্গলের মাটির অনুকরণ করেছি। সেই সঙ্গে পৃথিবীতে মঙ্গলের পরিবেশের অনুকরণ করে এসব মাটি নিয়ে পরীক্ষা করেছি।’
গবেষকেরা ১ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে বিশুদ্ধ আয়রন তৈরি করতে সক্ষম হন এবং ১ হাজার ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আয়রন-সিলিকন অ্যালোই তৈরি করতে সক্ষম হন।
প্রফেসর রামধানি বলেন, ‘যত উচ্চ তাপমাত্রায় এটি গরম করা হয়, তত ধাতুগুলো একত্রিত হয়ে একটি বড় ড্রপলেট বা তরল বিন্দুর মতো গঠিত হয়। এটি পরে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য (স্ল্যাগ) থেকে পৃথিবীর মতো করেই আলাদা করা সম্ভব।
এ ছাড়া ড. নবাবান, প্রফেসর রামধানি এবং সিএসআইআরওর ড. মার্ক পাউনসবি একই সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার উন্নত করতে কাজ করছেন। তাদের লক্ষ্য হলোÑ এই প্রক্রিয়া যাতে কোনো বর্জ্য না তৈরি করে এবং সমস্ত প্রক্রিয়া উপযোগী উপকরণে রূপান্তরিত হয়। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে অ্যাক্টা অ্যাস্ট্রোনটিকা নামক আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা সাময়িকীর দুটি গবেষণাপত্রে।
মহাকাশ গবেষণায় একটি বাড়তি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে ইন-সিচু রিসোর্স ইউটিলাইজেশন (আইএসআরইউ)। কারণ রকেট উৎক্ষেপণের খরচ এখনো অনেক বেশি এবং যে কোনো এক কিলোগ্রামও মহাকাশে পাঠানোর জন্য মূল্যবান।
তবে, এরই মধ্যে অনেক বড় সাফল্যও এসেছে, যেমন: মঙ্গলের পারসিভারেন্স রোভারের মক্সি (গঙঢওঊ) পরীক্ষা, যা মঙ্গলের বায়ুম-লে উপস্থিত কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসযোগ্য অক্সিজেন তৈরি করেছে।
এবার ধাতু উৎপাদনই হতে যাচ্ছে পরবর্তী বৃহত্তম পদক্ষেপ। প্রফেসর রামধানি আশা করছেন, মঙ্গলে তৈরি ধাতু দিয়ে গৃহ নির্মাণের উপকরণ বা গবেষণাগারের কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হবে, এমনকি খননযন্ত্র তৈরি করাও।
ড. নবাবান বলেন, ‘এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে যে এই ধাতুগুলো সময়ের সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে এবং সত্যি কি এই প্রক্রিয়া মঙ্গল গ্রহের আসল পরিবেশে সফলভাবে চালানো সম্ভব হবে।’
এ ছাড়া, সুইনবার্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার সহযোগীরা এই গবেষণায় ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। প্রফেসর রামধানি ও তার সহযোগীরা সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি চার দিনব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করেছেন, যা আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছে।
ড. নবাবান এই গবেষণার সম্ভাব্য সুবিধাগুলো শুধু মহাকাশ গবেষণার জন্যই দেখছেন না, বরং পৃথিবীতেও ধাতু নির্মাণ প্রযুক্তির উন্নতি ঘটানোর ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, ‘এই গবেষণার মাধ্যমে আমি চাই মহাকাশ গবেষণার উন্নতি ঘটাতে এবং শেষে এটি পৃথিবীতেও মানবজীবনকে উন্নত করতে সাহায্য করবে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন