সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


নিজস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২৫, ০৯:২৭ এএম

জাল সনদে কলেজের  আয়া থেকে প্রভাষক!

নিজস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২৫, ০৯:২৭ এএম

হোসনে আরা

হোসনে আরা

এইচএসসি পাস করে কলেজে আয়ার চাকরি নেন হোসনে আরা। পরে কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলামের নিয়োগ বাণিজ্যের সুযোগে ডিগ্রি পাসের সনদ জাল করে একই কলেজে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। এতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-স্থানীয়দের মাঝে সমালোচনার সৃষ্টি হলে গত ছয় মাস ধরে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন হোসনে আরা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর হোসনে আরার মতো আরও ২২ জনের নিয়োগে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে কয়েক কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। প্রতি শিক্ষক নিয়োগে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে কলেজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। পরে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পাঁচ শিক্ষকের এমপিও স্থগিত করা হয়।

ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার এন ইসলামিয়া একাডেমি কলেজে এমন ঘটনাই ঘটেছে। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সূত্র জানায়, ২০০০ সালে জরাজীর্ণ টিনের ঘরে প্রতিষ্ঠিত হয় এন ইসলামিয়া একাডেমি কলেজ। ২০১৬ সালে কলেজটি এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অডার্র) ভুক্ত হয়। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে হঠাৎ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

নিয়োগপ্রাপ্ত ২২ জনকে ৫ আগস্টের পর কলেজে দেখে হতভম্ব প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ের খবর জানতে কলেজটিতে গেলে অধ্যক্ষের এমন কর্মকা-ে ক্ষোভ জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর কলেজের একটি অনুষ্ঠানে খাদ্য ও পুষ্টির শিক্ষক হিসেবে আকরামুল স্যারকে অন্যান্য শিক্ষকরা পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের কলেজে এই বিষয়ে কোনো শিক্ষার্থী নেই। তিনি নাকি ২০১৬ সাল থেকে আমাদের কলেজে শিক্ষকতা করছেন। শিক্ষকরা যদি এমন ছলচাতুরী করেন, তাহলে আমাদের কী অবস্থা হবে।

ফাহিমা সুলতানা নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ৫ আগস্টের পর কলেজে নতুন নতুন স্যাররা আসছেন। তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কলেজে তাদের নিয়োগ অনুযায়ী কোনো সাবজেক্ট নেই। তারা তাহলে কাদের পড়াবেন। এসব বিষয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

একই ক্লাসের মানবিক বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী নাফিজা আক্তার কারিনা বলেন, শুনেছি হোসনে আরা প্রভাষক হয়েছেন। কয়েক দিন আগেও যিনি আমাদের বেঞ্চ, টেবিল, রুম পরিষ্কারসহ অন্যান্য কাজ করতেনÑ তার নিয়োগ কীভাবে হলো। সংস্কৃতি বিষয়ের প্রভাষক হওয়ার পর থেকে তিনি আর কলেজে আসছেন না। এসবের দায় কার আমরা জানতে চাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না থাকার সুযোগ নিয়ে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম ৫ আগস্টের পর ২২ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। যাদের নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০০৪ এবং ২০১৬ সালে। নিয়োগে ১৫ থেকে ২৫ লাখ করে প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন অধ্যক্ষ। যারা শিক্ষার্থীবিহীন বিভিন্ন সাবজেক্টে নিয়োগ পেয়েছেন, তারাও অধ্যক্ষকে চাপ দিচ্ছেন টাকা ফেরতের। নামে-বেনামে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

অভিযোগ উঠেছে, প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম শিক্ষা সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে আয়া হোসনে আরাকে সংস্কৃতির প্রভাষক, শিক্ষার্থী নেই তবুও ইতিহাসে পড়াশোনা করা এনামূল কবীরকে পালির প্রভাষক, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা আকরামুল ইসলামকে খাদ্য ও পুষ্টির প্রভাষক, সমাজকর্ম নিয়ে পড়াশোনা করা মাকসুদা বেগমকে গার্হস্থ্য অর্থনীতির প্রভাষক, মো. রাজন মিয়াকে চারু ও কারুকলার প্রভাষক, আলী মর্তুজাকে গৃহ ও পারিবারিক জীবন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রভাষক, উচ্চ মাধ্যমিক পাস নুরুজ্জামানকে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে প্রভাষক, তানজিনা আক্তারকে ভূগোলের প্রভাষক, আশরাফুন নাহারকে সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক, ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করা এনামুল হককে নাট্যকলার প্রভাষক, একই কলেজ থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করা রাসেল মিয়াকে সংগীতের প্রভাষক, ২০১৩-১৪ সেশনে দর্শনে মাস্টার্স করা আকলিমা আক্তারকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়নে। এ ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা রফিকুল ইসলামকে মনোবিজ্ঞানের, ইসলামিক স্টাডিজে পড়াশোনা করা রহিম উদ্দিনকে আরবির প্রভাষক করা হয়েছে। প্রাণিবিদ্যা বিষয় না থাকলেও ল্যাব সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নিলুফা আক্তারকে। এ ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে অফিস সহকারী নিয়োগ এবং একই প্রভাষককে দুই বিষয়ে নিয়োগ দেখিয়ে ২২ জনের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। 

এমপিওর অনলাইন কপি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা আকরামুল ইসলাম শুধু খাদ্য ও পুষ্টির প্রভাষক নন। তিনি শিল্পকলা এবং কারুশিল্পেরও প্রভাষক।

এ বিষয়ে আকরামুল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সালে কম্পিউটার প্রদর্শক হিসেবে নিয়োগ পাই। পরে সেটি পরিবর্তন করে অধ্যক্ষ স্যার আমাকে শিল্পকলা এবং কারুশিল্পে এমপিওভুক্ত করেন। বিষয়টি পছন্দ না হওয়ায় খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে সর্বশেষ প্রভাষক হিসেবে সুযোগ পাই। আমার অভিজ্ঞতা থাকায় এই বিষয় পড়াতে কোনো সমস্যা হবে না। 

এ বিষয়ে কলেজে শিক্ষার্থী নেই, তবে কাকে পড়াবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষার্থী ভর্তি হলেই পড়াব। ইসলামিক স্টাডিজে পড়াশোনা করে আরবির প্রভাষক হওয়া রহিম উদ্দিন বলেন, আরবি বিষয়েও আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে। একটি কোর্স করেছিলাম, তাই প্রভাষক হয়েছি।

কত টাকার বিনিময়ে জাল সনদে প্রভাষক হয়েছেনÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, টাকা তো কিছু খরচ হয়েছে।

আয়া থেকে জাল সনদে সংস্কৃতির প্রভাষক হওয়া হোসনে আরা সমালোচনার মধ্যে যাচ্ছেন না কলেজে। তার গ্রামের বাড়ি শাহবাজপুরে গেলেও তিনি দেখা করেননি। নাম না বলে তার ষাটোর্ধ্ব মা বলেন, ‘জমি বিক্রি করে মেয়েটা শিক্ষক হইচে। এখন তার নাকি অনেক সমস্যা চলছে। স্যাররা নাকি ঢাকায় দৌড়াইতেছে। কী জানি হয় বুঝতে পারতেছি না।’

কলেজে গিয়ে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা ক্লাস করাতে দেখা যায় প্রভাষক শহীদুল ইসলামকে। হোসনে আরার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কলেজটির প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে আমি রয়েছি। শিক্ষক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে হীনম্মন্যতায় ভুগছি। কারণ এই কলেজে আয়াও প্রভাষক আমিও প্রভাষক। কেন এমনটি করা হলো কার কাছে প্রশ্ন রাখব। অনেক শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, কিন্তু ওই বিষয়ে কলেজে কোনো শিক্ষার্থী নেই। নিয়োগ কারা সম্পন্ন করে আপনারা তাদের প্রশ্ন করুন।

ইংরেজির প্রভাষক তোফায়েল আহমেদ সবুজ বলেন, অন্য নিয়োগ কীভাবে হয়েছে না হয়েছে কখনো জানতে চাইনি। কিন্তু আয়াকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কলেজটিকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। অধ্যক্ষ স্যার কীভাবে এমন করলেন, তিনিই ভালো বলতে পারবেন।

এন ইসলামিয়া একাডেমি কলেজের অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, যে যে বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সবগুলোরই বোর্ড কতৃর্ক অনুমোদন রয়েছে। শিক্ষার্থী না থাকলেও হয়ে যাবে। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন।
পালি, খাদ্য ও পুষ্টি, চারু ও কারুকলা, নাট্যকলা এবং সংগীতে যারা নিয়োগ পেয়েছে তারা জাল সনদ ব্যবহার করেছেÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তাদের কাগজপত্র সব ঠিকঠাক রয়েছে। কারণ তারা বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে বিষয়ে পড়াশোনা করেছে।

১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে প্রত্যেককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছেÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কলেজে সবাই আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছে। তবে নিয়োগ বাবদ কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। একটি পক্ষ আমাকে বিপদে ফেলতে এসব প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে।

ময়মনসিংহ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. শহীদুল্লাহ বলেন, পালি, খাদ্য ও পুষ্টি, চারু ও কারুকলা, নাট্যকলা এবং সংগীতে কোনো শিক্ষার্থী ওই কলেজে নেই। তবে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। বোর্ড প্রতিষ্ঠার পর এসব বিষয়ে এইচএসসির কোনো পরীক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেনি। তার মানে কোনো কলেজে এসব বিষয় থাকারও কোনো সুযোগ নেই। সেখানে গরমিল থাকলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ময়মনসিংহ অঞ্চল ব্যবস্থা নেবেন।

ময়মনসিংহ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অঞ্চলের পরিচালক অধ্যক্ষ এ কে এম আলিফ উল্লাহ আহসান বলেন, ৫ আগস্টের পর আমি যোগদান করেই ৫ জনের এমপিও স্থগিত করেছি। বিষয়গুলো গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, যারা অসৎ উপায়ে চাকরি নিয়েছেন, তাদের একজনও টিকতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, অবৈধ নিয়োগে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তার শাস্তি নিশ্চিতেও সুপারিশ পাঠানো হবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!