ব্যাংক খাতে গ্রাহকদের আস্থাহীনতার প্রবণতা কমেছে। ফলে আমানতকারীরা এখন ব্যাংকমুখী হচ্ছেন। সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত এক বছরে ব্যাংকের আমানতে ভিন্ন এক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বেশি সুদ নয়, বরং যেসব ব্যাংকের সেবার মান ও ভাবমূর্তি যত ভালো, সেগুলোর ওপরই গ্রাহকের আস্থা বেড়েছে। সময়োপযোগী সেবা প্রদানই এসব ব্যাংককে আমানত সংগ্রহের শীর্ষে নিয়ে গেছে। এসব ব্যাংককে আমানত সংগ্রহের জন্য বাড়তি কোনো তৎপরতাও চালাতে দেখা যায়নি। অর্থাৎ ভালো ব্যাংকগুলো এখন স্বাভাবিকভাবেই বেশি আমানত পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩০ জুন ব্যাংক খাতে আমানতের স্থিতি ছিল ১৮ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা, যা এ বছরের জুনের শেষে বেড়ে ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। গত এক বছরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমানত সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সিটি ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংকের। এই দুই ব্যাংকের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। একই সময়ে আমানত সংগ্রহে ইস্টার্ন ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের ২০ শতাংশের বেশি, যমুনা ব্যাংকের ১৯ শতাংশ ও ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, সুদসহ আমানতের স্থিতি হিসাব করা হয়। এক বছরে ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে গড়ে ১০ শতাংশের বেশি সুদ যুক্ত হয়। ফলে যাদের আমানতে প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের বেশি হয়েছে, তারা এ সময়ে ভালো করেছে বলে ধরা যায়।
বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের জুনের শেষে তাদের আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ৩০ জুন থেকে চলতি ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সিটি ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকটির আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এই ব্যাংকের রিটেইল আমানত বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা, ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট ও করপোরেট আমানত বেড়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। ইসলামি ধারায় আমানত প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। এ ছাড়া এসএমই ও এজেন্ট ব্যাংকিং আমানতও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘মানুষ এখন ভালো ও খারাপ ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছেন। এ জন্য আমানতে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমরা গত দেড় দশকে সিটি ব্যাংকের যে শক্তিশালী ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করেছি ও উন্নত সেবার মাধ্যমে আস্থা অর্জন করেছি, তাতে গ্রাহকেরা আমাদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক বছরে ব্র্যাক ব্যাংকের আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এ বছরের জুনে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে হয়েছে ৭৯ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। গ্রামীণ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সেবা দিয়ে ব্যাংকটি সারা দেশে একটি বড় গ্রাহক ভিত্তি তৈরি করেছে, যা এই বিশাল প্রবৃদ্ধির পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে। ব্যাংকটি শাখা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বেশি আমানত পাচ্ছে।
গত অর্থবছরে ইস্টার্ন ব্যাংকের আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গত ৩০ জুন ব্যাংকটির সাধারণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের আমানতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ১৩ কোটি টাকা। তাতে ব্যাংকটি আমানত প্রবৃদ্ধির দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সুশাসন, পেশাদারিত্ব ও আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার কারণে এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের একটি ইস্টার্ন ব্যাংক। গ্রাহকের কাছেও ব্যাংকটি আস্থার। এ কারণে ব্যাংক খাতের অস্থির সময়ে এই ব্যাংকটিতে আমানত বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
এক বছরে পূবালী ব্যাংকের আমানতে ২০ দশমিক ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত জুনের শেষে এই ব্যাংকে আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। দীর্ঘদিনের গ্রাহকদের আস্থা এবং বিস্তৃত শাখা নেটওয়ার্কই এই প্রবৃদ্ধির প্রধান কারণ বলে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানান।
গত এক বছরে যমুনা ব্যাংকের আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৯ শতাংশ। ফলে গত জুনে তাদের আমানত বৃদ্ধি পেয়ে ৩২ হাজার ৮৮ কোটি টাকায় উঠেছে। একই সময়ে ট্রাস্ট ব্যাংকের আমানত ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেড়ে ৪০ হাজার ৩৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সীমান্ত ব্যাংক ও সিটিজেন ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধিও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আলোচ্য এক বছরে আমানত সংগ্রহে সীমান্ত ব্যাংকের ১৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং সিটিজেন ব্যাংকের ১৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত জুনের শেষে সীমান্ত ব্যাংকের আমানত বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ কোটি টাকায় ও সিটিজেন ব্যাংকে ১ হাজার ৯৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
একই সময়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। ফলে গত জুনে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে হয়েছে ৩১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। গত জুনে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের আমানত বেড়ে হয়েছে ৫৯ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা, তাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মিডল্যান্ড ব্যাংকের আমানত গত জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। একই সময়ে প্রাইম ব্যাংকে ৩৪ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংকে ২৭ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা, উত্তরা ব্যাংকে ২৩ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকে ৩০ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা ও ব্যাংক এশিয়ায় ৪৯ হাজার ২৯৪ কোটি টাকার আমানত ছিল।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমানতের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া হয়। ফলে ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদহার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। কিন্তু এর বিপরীতে ঋণের চাহিদা না থাকায় এবং ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদ কমে আসায় ভালো ব্যাংকগুলো এখন আমানতের সুদ বাড়িয়ে আগ্রাসী আচরণ করছে না। এরপরও ভালো আমানত পাচ্ছে অধিকাংশ ভালো ব্যাংক। কারণ, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং তথা মোবাইল অ্যাপ, অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম সেবা এবং কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেনের সুবিধা চালু করে তারা ব্যাংকিং সেবাকে সহজ করে দিয়েছে। ফলে মানুষ এখন ঘরে বসেই ব্যাংকে আমানত জমা করতে পারছেন, যা স্বস্তি দিচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ব্যাংকই একমাত্র মাধ্যম যেখানে আমানত রাখা যায়, ঋণ নেওয়া যায়, আমদানি-রপ্তানিসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। ফলে মানুষ খুব বেশি দিন ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখতে পারবে না। ব্যাংকে আসতেই হবে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে, সেসব ব্যাংকে টাকা উত্তোলনের চাপ অনেক বেড়ে গেছে। মানুষ দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সবল ব্যাংকে রাখবে- এটাই স্বাভাবিক।
ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর কয়েকটি ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কমে গিয়েছিল। ফলে তারা ওইসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছিল। যার প্রভাব পুরো ব্যাংক খাতেই পড়েছিল। তবে বর্তমানে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে আমানতের পরিমাণও বাড়ছে। আশা করি ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। যা আগের মাস জুনে ছিল ৯৬ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে ধরে রাখা টাকার পরিমাণ কমেছে ৯ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ০৯ শতাংশ। যদিও মে মাসে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়েছিল ১৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে চলমান অনিশ্চয়তা এবং বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের প্রভাবে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে ধরে রেখেছে। ফলে আমানত অস্বাভাবিক হারে কমে গিয়েছিল। আর ব্যাংকের বাইরে রাখা টাকার পরিমাণ বাড়ছিল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগে ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। ফলে গ্রাহকদের মধ্যে যারা অতিরিক্ত টাকা তুলেছিলেন, সেই টাকা আবার ব্যাংকে রাখতে শুরু করেছেন।
আবার সুদের হার বাড়ায় নতুন আমানতও ব্যাংকে আসছে। তবে তার পরিমাণ খুব বেশি না। কারণ দীর্ঘদিন ধরে মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বেকারত্ব। এ কারণে সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকের আমানতও প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না। আমানত না বাড়লে বিনিয়োগ বাড়বে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না, আয় বাড়বে না, সঞ্চয়ও বাড়বে না। ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য স্থিতিশীল বিনিয়োগ পরিবেশের ওপর জোর দেন তিনি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন