ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা বেক্সিমকো গ্রুপের মালিক সালমান ফজলুল রহমান (সালমান এফ রহমান) ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে করোনাকালীন ১২ হাজার কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। গার্মেন্টস ও মাস্ক রপ্তানির অন্তরালে এ টাকা পাচারের অভিযোগে করা মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে উঠে আসে, দেশ থেকে পণ্য রপ্তানি করা হলেও রপ্তানি আয়ের এক টাকাও দেশে ফেরত আসেনি। করোনাকালীন গার্মেন্টস-পণ্য ও মাস্ক রপ্তানির আড়ালে বিপুল পরিমাণ এ অর্থ পাচার করে সালমান এফ রহমানের পরিবারের সদস্যরা। এতে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৭ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছিল। ১৪ মাস আগে করা ১৭ মামলার তদন্ত শেষে অর্থপাচারের অভিযোগে সালমান এফ রহমানসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিলের প্রস্তুতি নিয়েছে সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সিআইডি জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন ১৭ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় বেক্সিমকো গ্রুপ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সেই ঋণের টাকায় গার্মেন্টস পণ্য ও মাস্ক উৎপদান করে তা রপ্তানি করে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে রপ্তানি আয়ের টাকা দেশে আনার ঘোষণা ছিল বেক্সিমকো গ্রুপের। পণ্য পাঠানো হলেও পণ্যের মূলবাবদ ৯ কোটি ৬৯ লাখ ৬৬ হাজার ৮০২ দশমিক ২৮ ইউএস ডলার দেশে ফেরত আসেনি। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ফেরত না আনা রপ্তানি পণ্যের আয়ের টাকা দুবাইতে নিজ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপ। পটপরিবর্তনের পর এ ঘটনায় অনুসন্ধান শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর একযোগে ১৭টি মামলা করে সিআইডি। মামলায় মোট ২৮ জনকে আসামি করা হয়। দীর্ঘ ১ বছর ২ মাসের মধ্যে সব মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের প্রস্তুতি নিয়েছে।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি ছিবগাৎ উল্লাহ জানান, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যাস সালমান এফ রহমান এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৭ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। প্রাথমিক তদন্তে সিআইডির জানতে পেরেছে, বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান এ এস এফ রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং সহযোগীগণ ১৭টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে এই অর্থ পাচারের সাথে যুক্ত ছিলেন। স্কাইনেট এপারেলস লিমিটেড, আরবান ফ্যাশনস, অটাম লুপ এপারেলস লিমিটেড, এপোলো এপারেলস লিমিটেড, এডভেঞ্চার গার্মেন্টস লিমিটেড, পিঙ্ক মেকার গার্মেন্টস লিমিটেড পিয়ারলেস গার্মেন্টস লিমিটেড, মিডওয়েস্ট গার্মেন্টস লিমিটেড, কাঁচপুর এপারেলস লিমিটেড, কোজি এপারেলস লিমিটেড, বেক্সটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেড, কসমোপলিটন এপারেলস লিমিটেড, স্প্রিংফুল এপারেলস লিমিটেড, উইন্টার স্প্রিট গার্মেন্টস লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার এপারেলস লিমিটেড, এসেস ফ্যাশন লিমিটেড এবং প্লাটিনাম গার্মেন্টস লিমিটেডের মাধ্যমে ৯ কোটি ৬৯ লাখ ৬৬ হাজার ৮০২ দশমিক ২৮ ইউএস মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হলেও অর্থ দেশে আসেনি।
সিআইডি প্রধান জানান, অভিযোগে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো সবাই গাজীপুরে জেলায় অবস্থিত। এগুলো বেক্সিমকো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দুবাইতে অবস্থিত সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন আর আর গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের কাছে গার্মেন্টস ও মাস্ক রপ্তানি করা হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে দুবাইতে অবস্থিত নিজের মালিকানাধীন আরেকটি প্রতিষ্ঠানে পণ্য রপ্তানি দেখানো হয়। দুবাইতে অবস্থিত আর আর গ্লোবাল ট্রেডিং নামের প্রতিষ্ঠানটি সালমান এফ রহামনের ছেলে আহমেদ শায়ন ফজলুর রহমান এবং ভাই এ এস এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শাহরিয়ার রহমান পরিচালনা করে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য রপ্তানি দেখানো হলেও প্রতিষ্ঠানটি ছিল সালমান এফ রহমান ও তার পরিবারের মালিকানাধীন অরেকটি প্রতিষ্ঠান। পণ্য রপ্তানি হলেও রপ্তানি মূল্য দেশে আনা হয়নি। অর্থাৎ কৌশলে ১১৬৩ কোটি ৬০ লাখ ১৬ হাজার ২৭৩ দশমিক ৬০ টাকা পাচার করা হয় রপ্তানির আড়ালে। ওই টাকা মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ঋণের টাকা উৎপাদন খাতে খরচ দেখানো হয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৭ মামলায় বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, একই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এ এস এফ রহমান (সালমান এফ রহমানের ভাই), ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান, ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমান কমন আসামি। এর বাইরে আসামি হয়েছেনÑ আনোয়ারুল বাশার, নাসরিন আহমেদ, হেলাল উদ্দিন, শাহিদা রহমান, ওয়াসিউর রহমান, রোজিয়া আক্তার, সৈয়দ ফরিদুজ্জামান, কামরুন নাহার, কাজী উম্মে কুলসুম মৈত্রী, রুম্মান মোহাম্মদ ফাহিম খান, কোহিনুর আবেদিন, মোহাইমিনুল ইসলাম, মাহফুজুর রহমান খান, সৈয়দ তানভীর এলাহী আফেন্দী, মাশকুরা খানম, মো. সাইফুর রহমান, সাজিয়া জামান, খাদিজা বিনতে আলম, ইমরান খান মসলিশ, আহমেদ জালাল খান মজলিস, আবু নাইম মাহমুদ সালেহীন, মোস্তাফিজুর রহমান তানভীর, মোহাম্মদ আলিফ ইবনে জুলফিকার ও নুসরাত হায়দার।
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, রপ্তানি পণ্যের আড়ালে স্কাইনেট এপারেলস লিমিটেডের মাধ্যমে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪৯৯ মার্কিন ডলার, আরবান ফ্যাশনস লিমিটেডের মাধ্যমে ১ কোটি ৪৪ লাখ ৬১ হাজার ৫৭৬ দশমিক ৮০ মার্কিন ডলার, অটাম লুপ এপারেলস লিমিটেডের মাধ্যমে ২৮ লাখ ৩২ হাজার ৪২৮ মার্কিন ডলার, এপোলো এপারেলস লিমিডেটের মাধ্যমে ২ কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার, এডভেঞ্চার গার্মেন্টসের মাধ্যমে ২৩ লাখ ২৮ হাজার ৭৫০ মার্কিন ডলার, পিঙ্ক মেকার গার্মেন্টস লিমিটেডের মাধ্যমে ২৬ লাখ ৬৩ হাজার ১৭৬ মার্কিন ডলার, পিয়ারলেস গার্মেন্টসের মাধ্যমে ১৯ লাখ ৪৭ হাজার মার্কিন ডলার, মিডওয়েস্ট গার্মেন্টস লিমিটেডের মাধ্যমে, ২৯ লাখ ২৫ হাজার মার্কিন ডলার, কাঁচপুর এপারেলস লিমিটেডের মাধ্যমে ২৯ লাখ ৭৯ হাজার ৯২০ মার্কিন ডলার, কেজি এপারেলস লিমিটেডের মাধ্যমে ১৯ লাখ ৬৪ হাজার ২৫০ মার্কিন ডলার এবং বেক্সটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেডের মাধ্যমে ১ হাজার ৯০৩ কোটি ২ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হলেও পণ্যের পরিশোধ মূল্যের কোনো টাকাই দেশে আসেনি। এসব টাকা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন দুবাইয়ে অবস্থিত আর আর গ্লোবাল ট্রেডিংয়ে পাচার হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সালমান এফ রহমান ও তার পরিবারের ভাই, ছেলে ও ভাতিজাসহ ৩৪ জনের নামে সম্প্রতি জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৫টি পৃথক মামলা করেছিল। ওই মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের অনেকেই সিআইডির মামলায়ও আসামি হয়েছেন।
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের পর তাদের গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারির জন্য আবেদন করা হবে। সেই আবেদন আসামিদের ঠিকানা সংশ্লিষ্ট থানা এলাকাগুলোতে পাঠানো হলে গ্রেপ্তারে মাঠে নামবেন। ইতিমধ্যে এ ১৭ মামলায় কারাগারে থাকা সালমান এফ রহমানকে শ্যোন এরেস্ট দেখানো হয়েছে। এর বাইরে ১ জনকে সিআইডি গ্রেপ্তার করেছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনতে সরকারের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন