ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তিনটি নতুন রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ সময় দল নিবন্ধনের চূড়ান্ত তালিকা থেকে ছিটকে পড়ে আম জনতার দল। দলটিকে নিবন্ধন না দেওয়ার কারণ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জানিয়েছে শর্ত পূরণে ব্যর্থ আমজনতার দল। তবে নিবন্ধন না পেয়ে গত ৪ নভেম্বর, মঙ্গলবার বিকেল থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের মূল ফটকের সামনে আমরণ অনশনে বসেছেন দলটির সদস্যসচিব তারেক রহমান। প্রায় ১৩২ ঘণ্টা ধরে তার এই অনশনের পর শারীরিক অবস্থারও অবনতি ঘটলে গতকাল রোববার রাতে তাকে জরুরি হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যেই বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তারেকের অনশনকে সমর্থন জানিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করে।
সর্বশেষ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের দাবিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ফটকের সামনে আমরণ অনশনরত আমজনতার দলের সদস্যসচিব তারেক রহমানকে দেখতে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ। এর আগে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী তারেকের সঙ্গে দেখা করে তার অনশনকে সমর্থন জানান। বিভিন্ন দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তারেককে সমর্থন জানালেও নির্বাচন কমিশন বলছে, বিদ্যমান আইনের শর্ত পূরণ না করার কারণেই নিবন্ধন পায়নি আম জনতার দল। তারেক চাইলে আদালতের দ্বারস্থও হতে পারেন বলে জানিয়েছে ইসি।
রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের দাবিতে ইসি প্রধান ফটকের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করে আসছেন তারেক রহমান। কিন্তু এ কর্মসূচি ৫২২ ঘণ্টা হলেও কিছু করার নেই বলে জানিয়েছেন ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। গতকাল রোববার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, ‘ক্যান ইলেকশন কমিশন গো বিয়ন্ড দ্য রুলস? সো... গট মাই আনসার।’
শর্ত পূরণ না করায় নিবন্ধন দেয়নি ইসি: দলটিকে নিবন্ধন না দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে গত বুধবার নির্বাচন কমিশন একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৯০খ (১) (ক) (ই)-এর শর্তাবলি সঠিকভাবে পালন না করা, দুই-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা দপ্তরের বাড়ি ভাড়ার রসিদ, চুক্তিপত্র বা মালিকানা দলিল সংযুক্ত না করা এবং দলের নামে রক্ষিত ব্যাংকের তথ্য দাখিল না করাসহ বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়।
জেলা কার্যালয়ের তথ্য ঘাটতি: দুই-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা দপ্তরের বাড়ি ভাড়ার রসিদ, চুক্তিপত্র বা মালিকানা দলিল সংযুক্ত করা হয়নি। মাঠপর্যায়ের তদন্তে ২২টির মধ্যে মাত্র ২০টি জেলায় সঠিক ও কার্যকর অফিস থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
উপজেলা বা থানা অফিসের তথ্য ঘাটতি: নিবন্ধনের শর্তানুযায়ী ১০০টি উপজেলা বা থানা অফিসের মধ্যে মাত্র ৩৩টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন থানায় অফিস ও ২০০ জন ভোটার সদস্য থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
আর্থিক তথ্য অনুপস্থিতি: দলের নামে রক্ষিত ব্যাংকের তথ্য এবং দলের তহবিলের উৎসের বিবরণ দাখিল করা হয়নি।
গঠনতন্ত্রে অসংগতি : গঠনতন্ত্রে কোনো পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ মহিলা সদস্য পদ সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়নি।
অঙ্গসংগঠন সংক্রান্ত বিধান: গঠনতন্ত্রে শিক্ষক, ছাত্র, শ্রমিক ইত্যাদি পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠন না থাকার বিধান রাখা হয়নি।
ক্ষমতাপত্র এবং প্রত্যয়নপত্রের অভাব: নিবন্ধনের আবেদন করার জন্য দল প্রদত্ত ক্ষমতাপত্র এবং সংবিধান পরিপন্থী না হওয়া ও দ-িত ব্যক্তি না থাকার বিষয়ে দলের প্রধানের ইস্যুকৃত প্রত্যয়নপত্র দাখিল করা হয়নি।
ইসিকে প্রতারক বললেন তারেক: নিবন্ধন না দেওয়ার কারণ জানিয়ে ইসির দেওয়া চিঠিকে প্রতারণামূলক আখ্যা দিয়েছেন অনশনরত তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘ইসি আমাদের একটা প্রতারণামূলক চিঠি দিয়েছে। আমরা নাকি ব্যাংক তথ্য দিইনি, ৩৩ শতাংশ নারীর বিধান রাখা হয়নি... এগুলো তারা একটা মিথ্যা ক্লেইম করছে।’ তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘আমাদের বলছে ২২টা জেলায় লাগবে, আমাদের ২০টা জেলায় অফিস পেয়েছে। দুইটা জেলায় নাকি পায়নি। আমাদের তো ৪৩টা জেলায় কমিটি আছে। তারা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।’
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ রূপালী বাংলাদেশেকে বলেন, ‘দল নিবন্ধনের গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আম জনতার দল শর্ত পূরণে অনেক পিছিয়ে ছিল। আমাদের চেষ্টা ছিল, যেসব দল শর্ত পূরণের কাছাকাছি থাকবে তাদের বিষয়টি বিবেচনার জন্য। কিন্তু তারা জেলা ও উপজেলা অফিস বা কমিটিতে অনেক পিছিয়ে ছিল। এজন্য দল নিবন্ধনের বিষয়টি চূড়ান্ত করার আগে একাধিকবার বিভিন্ন অফিসার দিয়ে তদন্ত করিয়েছি। এখন তারা নির্বাচন কমিশনের সামনে অনশন না করে আদালতে যেতে পারে বা চিঠিতে যেসব শর্ত পূরণ হয়নি সেগুলো পূরণ করতে পারে। কারণ, নির্বাচন কমিশন আইনের বাইরে গিয়ে কিছুই করতে পারে না।’
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) শর্ত পূরণ না করে কোনো দলের অনশন করা এবং সেটিকে সংহতি জানানো আইনের পরিপন্থি বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ড. মো. শাহজাহান। তিনি বলেন, ‘দেশের আইন-কানুন না মেনে অনশন করে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করলে নির্বাচন কমিশনকে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশনের শর্ত যদি পূরণ না করে কেউ অনশন করে এবং এই কাজটাকে যদি কেউ সমর্থন জানায়, তাহলে সেটা আইনের পরিপন্থি হবে। আইন কেন প্রণয়ন করা হয়? কারণ আইনটা যাতে সবাই মানে। আর যদি কেউ না মানে, তাহলে ওই আইনটা প্রয়োগ করে আদালতে বিচার দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন যে আইনটা করেছে, সেটার অনুমোদন আছে এবং তারা আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যদি আম জনতার দল মনে করে আরপিও-এর বিধিবিধানের আলোকে তাদের দাবি সঠিক, তবে তাদের উচিত হবে অনশন না করে আইনি পথে হাঁটা। এখন আরপিও-এর বিধিবিধানের আলোকে যদি তার (আম জনতার দল) দাবি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে উনি আদালতে মামলা করতে পারেন। আমরণ অনশনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করা হলেও ইসিকে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকতে হবে বলে মনে করেন এই আইন বিশেষজ্ঞ।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন