মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আল শাহারিয়া

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২৫, ০১:৪৪ এএম

বায়ুদূষণে নির্মল বাতাসের অধিকার থেকে বঞ্চিত ঢাকাবাসী

আল শাহারিয়া

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২৫, ০১:৪৪ এএম

বায়ুদূষণে নির্মল বাতাসের অধিকার থেকে বঞ্চিত ঢাকাবাসী

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকা যখনই প্রকাশিত হয়, ঢাকা প্রায় নিয়ম করেই সেই তালিকার শীর্ষে বা তার কাছাকাছি অবস্থান করে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই মিটারে ঢাকার স্কোর নিয়মিতভাবেই অস্বাস্থ্যকর, বিপজ্জনক বা দুর্যোগপূর্ণ স্তর অতিক্রম করে। বিশেষ করে শীতের মৌসুমে এ শহরের বাতাস হয়ে ওঠে এক বিষাক্ত গ্যাস চেম্বার। কিন্তু, এই পরিসংখ্যান বা সূচকের ওঠানামা আমাদের কাছে গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমরা মাস্কে মুখ ঢেকে স্রেফ ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে এই বাতাসেই নিঃশ^াস নিই। আমরা হয়তো ভাবি, এটা স্রেফ ধুলাবালি বা সামান্য অস্বস্তির বিষয়।

এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল। ঢাকার এই বিষাক্ত বাতাস কেবল একটি পরিবেশগত বিড়ম্বনা নয়। এটি একটি নীরব ঘাতক। এটি একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা যা আমাদের অগোচারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে এটি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ওপর এমন এক অদৃশ্য করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে, যার খেসারত আমরা দিচ্ছি প্রতিদিন। এই দূষণ আমাদের ফুসফুসে এবং অর্থনীতিতে একযোগে পচন ধরাচ্ছে। সময় এসেছে একে কেবল পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে না দেখে, একটি জাতীয় সংকট হিসেবে চিহ্নিত করার।

বায়ু দূষণের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং প্রত্যক্ষ শিকার আমাদের জনস্বাস্থ্য। ঢাকার হাসপাতালগুলো এর জীবন্ত সাক্ষী। প্রতি বছর শীত মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে রোগীর ঢল নামে। এদের একটি বিশাল অংশই শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা নিয়ে আসে। শিশু এবং বয়স্ক নাগরিকরাই এই দূষণের সবচেয়ে সহজ শিকারে পরিণত হন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের কান্নার শব্দে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো ভারি হয়ে ওঠে। অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগীদের জন্য এই সময়টা আক্ষরিক অর্থেই বেঁচে থাকার লড়াই। ইনহেলারের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ে, ঘন ঘন হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

কিন্তু, সমস্যাটি যদি কেবল মৌসুমি সর্দি-কাশি বা নিউমোনিয়ার মতো রোগে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলেও হয়তো আমরা সামলে ওঠার কথা ভাবতে পারতাম। আসল বিপদ লুকিয়ে আছে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে। বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা, যা পিএম ২.৫ নামে পরিচিত, তা এতই ক্ষুদ্র যে শ্বাসের সঙ্গে সরাসরি আমাদের রক্তপ্রবাহে মিশে যেতে পারে। এই কণাগুলো আমাদের ফুসফুসের অ্যালভিওলাই থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের কোষ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে সক্ষম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ল্যানসেটের মতো শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসা সাময়িকীর বিভিন্ন গবেষণায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, দীর্ঘমেয়াদি বায়ু দূষণের সংস্পর্শে থাকা ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। শুধু তাই নয়, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের মতো অসংক্রামক ব্যাধির পেছনেও এই দূষণের বড় ভূমিকা রয়েছে। ঢাকার বাতাসে সিসা, ক্যাডমিয়াম এবং অন্যান্য ভারী ধাতুর উপস্থিতি এই ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

সবচেয়ে ভীতি-জাগানিয়া তথ্যটি হলো শিশুদের ওপর এর প্রভাব। যে শিশুরা এই বিষাক্ত বাতাসে বেড়ে উঠছে, তাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চমাত্রার দূষণের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বা আইকিউ হ্রাস পায়। তাদের শেখার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আমরা যখন একটি স্মার্ট বাংলাদেশ বা উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি, তখন আমাদের অজান্তেই এই বিষাক্ত বাতাস একটি দুর্বল ও অসুস্থ প্রজন্ম তৈরি করছে। আমরা কি ভেবে দেখেছি, এই শিশুদের কাছে আমাদের কী জবাব আছে?

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর জিডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই ক্ষতির হিসাবটি আসে মূলত দুটি খাত থেকে। প্রথমত, অসুস্থতাজনিত কারণে কর্মদিবস নষ্ট হওয়া। যখন একজন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক দূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মে যেতে পারেন না, তখন তার ব্যক্তিগত আয়ের পাশাপাশি জাতীয় উৎপাদনেও ঘাটতি তৈরি হয়। একইভাবে, যখন শিশুর অসুস্থতার কারণে অভিভাবককে কর্মস্থল ত্যাগ করতে হয়, সেই ক্ষতিও অর্থনীতিতেই যোগ হয়। সব মিলিয়ে বছরে লাখ লাখ কর্মদিবস নষ্ট হচ্ছে কেবল এই একটি কারণে, যার আর্থিক মূল্য বিলিয়ন ডলারের বেশি।

দ্বিতীয় খাতের ক্ষতি আরও মারাত্মক। সেটি হলো চিকিৎসা ব্যয়। বায়ু দূষণজনিত রোগের চিকিৎসায় প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এই ব্যয়ের একটি বড় অংশ নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকে যাচ্ছে, যা তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য খাতের বাজেটের একটি বিশাল অংশ এই প্রতিরোধযোগ্য রোগগুলোর চিকিৎসায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। যে অর্থ দিয়ে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, পুষ্টি নিশ্চিতকরণ বা স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন করা যেত, সেই অর্থ ব্যয় হচ্ছে এমন এক রোগের পেছনে, যা আমরা নিজেরাই তৈরি করছি।

এর বাইরেও অর্থনৈতিক ক্ষতি রয়েছে। একটি শহর যখন বিশ্বের দূষিততম শহরের তালিকায় শীর্ষে থাকে, তখন তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নেতিবাচক বার্তা পাঠায়। কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের এমন একটি শহরে পাঠাতে দ্বিধা বোধ করে, যেখানে নিঃশ^াস নেওয়াটাই অনিরাপদ। পর্যটন শিল্পও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি দেশ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য যতটা আকর্ষণ তৈরি করতে পারে, রাজধানীর বিষাক্ত বাতাস সেই আকর্ষণকে ততটাই ম্লান করে দেয়। সুতরাং, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অজুহাতে দূষণকে সহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। বরং এই দূষণই আমাদের প্রবৃদ্ধিকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

ঢাকার এই ভয়াবহ দূষণের চিত্র কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফল নয়। এটি সম্পূর্ণরূপেই মানবসৃষ্ট এবং আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, এটি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা ও অব্যবস্থাপনার এক করুণ দলিল। এ দূষণের প্রধান উৎসগুলো আমাদের সবার জানা। শহর এবং এর আশপাশে গড়ে ওঠা হাজার হাজার অবৈধ ও সেকেলে প্রযুক্তির ইটের ভাটা এ দূষণের জন্য অনেকাংশে দায়ী। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কীভাবে বছরের পর বছর এই ভাটাগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়, তা এক বড় প্রশ্ন।

দ্বিতীয় প্রধান উৎস হলোÑ ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন এবং দুর্বল জ্বালানি মানের কারণে ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী বাস, ট্রাক এবং অন্যান্য যানবাহন প্রতিনিয়ত বিষাক্ত সিসা ও কার্বন কণা বাতাসে ছড়াচ্ছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দরকার, তা দৃশ্যমান নয়।

তৃতীয়ত, শহরজুড়ে চলমান অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ। কোনো ধরনের সুরক্ষাব্যবস্থা বা নিয়ম না মেনেই চলছে বড় বড় প্রকল্পের কাজ। নির্মাণসামগ্রী খোলা ফেলে রাখা, ধুলা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকাÑ এগুলোই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। চতুর্থত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। শহরজুড়ে যত্রতত্র আবর্জনা পোড়ানো হচ্ছে, যার মধ্যে প্লাস্টিকসহ নানা ধরনের বিষাক্ত উপাদান থাকে।

এই প্রতিটি উৎসের পেছনেই রয়েছে সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকট। আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। আইনের শাসনের এই অভাবই দূষণ সৃষ্টিকারীদের বেপরোয়া করে তুলেছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ এখন কেবল পরিবেশবাদীদের স্লোগান নয়, এটি রাষ্ট্রের সুশাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানসিকতার পরিবর্তন। নির্মল বাতাসের জন্য যে বিনিয়োগ, তাকে ব্যয় হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটিই হতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। আমরা যদি আজ এই বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হই, তবে অদূর ভবিষ্যতে এক অসুস্থ ও কর্মদক্ষতাহীন প্রজন্ম নিয়ে আমরা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যে স্বপ্ন দেখছি, তা কখনোই বাস্তবায়ন করতে পারব না। এই বিষাক্ত বাতাস আমাদের ভবিষ্যৎকেই শ্বাসরোধ করে হত্যা করবে।

লেখক : আল শাহারিয়া
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!