ঢাকা মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫

‘মৃতদের শহরে’ পরিণত গাজা

ভিনদেশ ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৫, ০৯:২৮ এএম

গাজা সিটির ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন সভ্যতার ধারক এই নগরী বারবার গড়ে উঠেছে এবং পরিবর্তিত হয়েছে। দুই বছর আগেও শহরটিতে ছিল প্রাণচাঞ্চল্য। আজ সেই গাজাই পরিণত হয়েছে ‘মৃতদের শহরে’। স্কুলের ক্লাসরুমগুলো ছিল শিক্ষার্থীতে পূর্ণ। বাজারে ছিল ক্রেতাদের ভিড়। আর সমুদ্রতীরবর্তী ক্যাফেগুলো ছিল চাপা জীবনের ক্লান্তি ভুলে কিছুটা স্বস্তি নেওয়ার জায়গা। আজ সবই শুধু সৃতি: ধূসর আর রক্তাক্ত।

 ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার সময় যে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছিল, তাদের অনেকেই আশ্রয় নেয় এই শহরে। শহরটিতে শত শত প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, যা এর অতীতকে ধারণ করে। এ কারণেই ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন (হামাস) গাজা সিটিকে তাদের প্রত্যক্ষ প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলে। দীর্ঘদিনের সংঘাত, ধ্বংসাত্মক অবরোধ এবং হামাসের একনায়কতান্ত্রিক শাসন ফিলিস্তিনিদের জীবন কঠিন করে তোলে। তবে কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের সরকারের সহায়তা এবং জাতিসংঘের ত্রাণকাঠামো গাজার মানুষের মধ্যে কিছুটা স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ভূমি, আকাশ ও সমুদ্রপথে ইসরায়েল ও মিশরের আরোপিত অবরোধ সত্ত্বেও গাজা সিটিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও সেই প্রচেষ্টা আজ নিথর।

হ্যাঁ, গাজাবাসীর জীবন কখনোই সহজ ছিল নাÑ অর্ধেক মানুষ ছিল বেকার। প্রতিটি রাস্তায় হামাসের কড়া টহল। কিন্তু কেউ চাইলেই পার্কে বিশ্রাম নিতে পারত বা বই হাতে এক কাপ কফি নিয়ে বসতে পারত। আজ সেই শহর সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের মাসব্যাপী বিমান ও স্থল হামলা গাজা সিটির সাংস্কৃতিক ও আর্থিক কেন্দ্রকে একটি আইনহীন ধ্বংসাবশেষে পরিণত করেছে।

এখন যখন ইসরায়েল আবার নতুন এক ‘চূড়ান্ত অভিযান’ শুরু করতে যাচ্ছে এই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, সেখানে লুকিয়ে থাকা হামাস যোদ্ধাদের নির্মূল করার লক্ষ্যে গাজার বাসিন্দারা আবারও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার ভয়াবহ লড়াইয়ের মুখোমুখি। গাজার বাসিন্দা চার সন্তানের পিতা মাজদি আবু হামদি (৪০) জানান, যে বিস্ফোরণের ধুলা বাতাসকে এতটাই ভারী করে তুলছে, তা ঘরের ভেতরে ঢুকে শ্বাস নেওয়াও কঠিন করে তুলেছে, বিশেষ করে ভাঙা জানালার কারণে। তিনি বলেন, এমনকি গাজায় ছুটে বেড়ানো কুকুরগুলোর আচরণও এখন বদলে গেছে। ‘রাতে কুকুরগুলোর চিৎকার শুনি। এত লাশ খেতে খেতে তারা এখন একেবারে হিংস্র হয়ে গেছে।

তাদের ঘেউঘেউ বদলে গেছেÑ এটা এখন রীতিমতো ভয়ংকর।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন কুকুরগুলো মানুষের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। পরিচিত মানুষকে আক্রমণ করছে। দুই দিন আগে একটি বিড়াল ভুল করে ওদের কাছাকাছি চলে গেলে ২০টিরও বেশি কুকুর একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে।’ মাজদি বলেন, পশুগুলো আগে এরকম ছিল না। কিন্তু এই মৃতদের শহর পশুগুলোকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। জানি না, এই পশুগুলোকেও ইসরায়েলি বাহিনী ছাড়বে কি না!

ইসরায়েলি নেতারা গাজা শহরের ওপর বৃহৎ পরিসরে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই ইসরায়েলি বিমান ও ট্যাংকগুলো গাজা শহরের পূর্ব ও উত্তর উপকণ্ঠে আঘাত হেনেছে, ভবন ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা শনিবার রাত থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত জেইতুন ও শেজাইয়া এলাকায় ক্রমাগত বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। ট্যাংকগুলো নিকটবর্তী সাবরাপাড়ায় বাড়িঘর ও রাস্তাগুলোতে গোলাবর্ষণ করেছে এবং জাবালিয়ার উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি ভবন উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিস্ফোরণের দিক থেকে আকাশে আগুন জ¦লে উঠেছে, যার ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং কিছু পরিবার শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। অন্য বাসিন্দারা বলেছেন যে তারা মরতে রাজি, কিন্তু শহর ছেড়ে যেতে রাজি নয়। গাজার অর্ধেকেরও বেশি বাসিন্দা এরই মধ্যে গাড়ি ও রিকশায় তাদের জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে। ৪০ বছর বয়সি মোহাম্মদ রয়টার্সকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে গাজা শহরে আমার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় গণনা করা বন্ধ করে দিয়েছি। কোনো জায়গা নিরাপদ নয়, তবে আমি ঝুঁকি নিতে পারি না। যদি তারা হঠাৎ আক্রমণ শুরু করে, তবে তারা প্রচ- গুলি চালাবে।’ তবে ৩১ বছর বয়সি আয়া বলেন, ‘আমরা যাচ্ছি না, তারা আমাদের বাড়িতে বোমা মারুক। আমরা ক্ষুধার্ত, ভীত এবং আমাদের কাছে অর্থ নেই।’

চলতি মাসের শুরুতে গাজা শহর দখলের জন্য ইসরায়েল একটি বর্ধিত সামরিক আক্রমণের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। ইসরায়েলি বাহিনী শহর ও আশপাশের এলাকায় বোমাবর্ষণ করেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ রোববার আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি গাজা শহর ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজার নাসের হাসপাতালে সোমবার (২৫ আগস্ট) কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে চারজন সাংবাদিক।

এর মধ্যে দুজন রয়টার্স ও আল-জাজিরায় কাজ করতেন বলে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। প্রথম হামলায় রয়টার্সের কন্ট্রাক্টর ক্যামেরাম্যান হুসাম আল-মাসরি নিহত হন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। দ্বিতীয় হামলায় রয়টার্সের কন্ট্রাক্টর ফটোগ্রাফার হাতেম খালেদ আহত হন, তারা আরও জানিয়েছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হামলা সম্পর্কে তৎক্ষণাৎ কোনো মন্তব্য করেনি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, দ্বিতীয় হামলাটি তখন ঘটেছিল, যখন উদ্ধারকর্মী, সাংবাদিক এবং অন্যান্য লোক প্রথম হামলার স্থানে ছুটে যান। রয়টার্সের লাইভ ভিডিও ফিড, যা পরিচালনা করেছিলেন আল-মাসরি, প্রথম হামলার মুহূর্তে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, রয়টার্সের ফুটেজে তা দেখানো হয়েছে।

গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা অন্য তিন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করেছেন, তারা হলেনÑ মারিয়াম আবু দাগগা, মুহাম্মদ সালামা এবং মওয়াজ আবু তালহা। এ ছাড়া একজন উদ্ধারকর্মী নিহতদের মধ্যে ছিলেন। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিশাল র‌্যালি হয়েছে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। যেখানে গাজাবাসীর জন্য ১০০ মিলিয়ন রিঙ্গিত সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। এদিকে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সেনেগালে। সে সময় গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান বিক্ষোভকারীরা।