- জমি বিক্রি করে আয়া থেকে কলেজের প্রভাষক, জানালেন মা।
- ২২ শিক্ষক নিয়োগে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন অধ্যক্ষ।
- কলেজে পালি, খাদ্য ও পুষ্টি, চারু ও কারুকলা, নাট্যকলা শিক্ষক আছে, শিক্ষার্থী নেই।
- অভিযোগের ভিত্তিতে ৫ শিক্ষকের এমপিও স্থগিত।
- আয়াকে প্রভাষক হিসাবে মানতে নারাজ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
- শিক্ষার্থী নেই, ভর্তি হলেই পড়াবেন শিক্ষক।
এইচএসসি পাস করে কলেজে আয়ার চাকরি নেন হোসনে আরা নামে এক নারী। পরে কলেজ অধ্যক্ষের নিয়োগ বাণিজ্যের সুযোগে ডিগ্রি পাসের সনদ জাল করে একই কলেজে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। এতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হলে, গত ছয় মাস ধরে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন হোসনে আরা।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর হোসনে আরার মতো আরও ২২ জন নিয়োগে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ অনুযায়ী, প্রতি শিক্ষক নিয়োগে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়। পরে তদন্তে প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে পাঁচ শিক্ষকের এমপিও স্থগিত করা হয়।
ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার এন ইসলামিয়া একাডেমি কলেজে এ ঘটনাগুলো ঘটে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০০০ সালে জরাজীর্ণ টিনশেড ঘরে প্রতিষ্ঠিত হয় এন ইসলামিয়া একাডেমি কলেজ। ২০১৬ সালে কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়। গেল বছরের ৫ আগস্টের পর হঠাৎ করেই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে।
নতুন নিয়োগ পাওয়া ২২ জনকে কলেজে দেখে হতবাক হন প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আসার পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কলেজে গিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘৫ আগস্টের পর কলেজের এক অনুষ্ঠানে খাদ্য ও পুষ্টির শিক্ষক হিসেবে আকরামুল স্যারকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। অথচ আমাদের কলেজে এই বিষয়ে কোনো শিক্ষার্থীই নেই। তিনি নাকি ২০১৬ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন!’
আরেক শিক্ষার্থী ফাহিমা সুলতানা বলেন, ‘নতুন নতুন স্যার আসছেন, পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু আমাদের কলেজে তাদের নিয়োগ অনুযায়ী কোনো সাবজেক্টই নেই। তারা তাহলে কাকে পড়াবেন? তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিজা আক্তার কারিনা বলেন, ‘শুনেছি হোসনে আরা ম্যাডাম হয়েছেন। কিছুদিন আগেও তিনি আমাদের বেঞ্চ, টেবিল, রুম পরিষ্কার করতেন। এখন তিনি কীভাবে প্রভাষক হলেন? আমরা তাকে ম্যাডাম কীভাবে ডাকব?’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না থাকায় সুযোগ নিয়ে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম ৫ আগস্টের পর ২২ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগপত্রে তাদের ২০০৪ ও ২০১৬ সালের তারিখ দেখানো হয়েছে। প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৫–২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন বলে অভিযোগ।
একই ব্যক্তিকে দুইটি বিষয়ের প্রভাষক দেখানো হয়েছে। এমনকি যেসব বিষয়ে কলেজে কোনো শিক্ষার্থী নেই- সেইসব বিষয়েও শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম শিক্ষাগত যোগ্যতা জালিয়াতির মাধ্যমে হোসনে আরাকে সংস্কৃতির প্রভাষক, ইতিহাসে পড়াশোনা করা এনামুল কবীরকে পালি বিষয়ের প্রভাষক, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আকরামুল ইসলামকে খাদ্য ও পুষ্টির প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেন।
এছাড়া, সমাজকর্মে ডিগ্রিধারী মাকসুদা বেগম গার্হস্থ্য অর্থনীতির প্রভাষক, রাজন মিয়া চারু ও কারুকলার প্রভাষক, আলী মতুর্জা গৃহ ও পারিবারিক জীবন ব্যবস্থাপনায় প্রভাষক, এইচএসসি পাস নুরুজ্জামান শারীরিক শিক্ষায় প্রভাষক, তানজিনা আক্তার ভূগোলের প্রভাষক, আশরাফুন নাহার সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক, এনামুল হক নাট্যকলার প্রভাষক, রাসেল মিয়া সংগীতের প্রভাষক, আকলিমা আক্তার মানব সম্পদ উন্নয়নে প্রভাষক, রফিকুল ইসলাম মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক, রহিম উদ্দিন আরবির প্রভাষক, নিলুফা আক্তার প্রাণীবিদ্যা বিষয় না থাকলেও ল্যাব সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান।
এছাড়াও নিয়মবহির্ভূতভাবে অফিস সহকারী নিয়োগ এবং একই শিক্ষককে একাধিক বিষয়ের প্রভাষক দেখানো হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
আকরামুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৬ সালে কম্পিউটার প্রদর্শক হিসেবে নিয়োগ পাই। পরে শিল্পকলা ও কারুশিল্পে এমপিওভুক্ত করা হয়। এরপর আবার খাদ্য ও পুষ্টিতে প্রভাষক হই। শিক্ষার্থী নেই, তবে ভর্তি হলে পড়াব।’
আরবি বিষয়ের প্রভাষক রহিম উদ্দিন বলেন, ‘ইসলামিক স্টাডিজে পড়েছি, তবে আরবিতেও কোর্স করেছি। তাই প্রভাষক হয়েছি।’
টাকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কিছু খরচ হয়েছে…’ (চোখে পানি চলে আসে।)
হোসনে আরার গ্রামের বাড়িতে গেলে দেখা মেলেনি। তাঁর ষাটোর্ধ্ব মা বলেন, ‘জমি বিক্রি করে মেয়ে শিক্ষক হয়েছে। এখন অনেক সমস্যা চলছে। স্যাররা নাকি ঢাকায় দৌড়াচ্ছে।’
প্রভাষক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এখানে আছি। আয়া প্রভাষক, আমিও প্রভাষক- নিজের পরিচয় দিতে এখন হীনমন্যতা লাগে।’
ইংরেজির প্রভাষক তোফায়েল আহমেদ সবুজ বলেন, ‘আয়াকে প্রভাষক করা কলেজকে ডুবিয়ে দিয়েছে।’
অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি নিয়োগ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত। শিক্ষার্থী না থাকলেও হয়ে যাবে। যারা বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক, তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছে। নিয়োগ বাবদ টাকা নেওয়া হয়নি, সবাই সহযোগিতা করেছে।’
ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘পালি, খাদ্য ও পুষ্টি, নাট্যকলা, চারু ও সংগীত বিষয়ে কোনো শিক্ষার্থী কলেজটিতে নেই। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে।’
ময়মনসিংহ অঞ্চলের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পরিচালক অধ্যক্ষ একেএম আলিফ উল্লাহ আহসান বলেন, ‘৫ আগস্টের পর যোগ দিয়ে পাঁচ জনের এমপিও স্থগিত করেছি। তদন্ত চলছে। কেউ অসৎ উপায়ে চাকরি পেলে টিকতে পারবে না। অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের সম্পৃক্ততা থাকলে তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’