আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ এবং আওয়ামী লীগসমর্থিত আরও কয়েকজন রাজনীতিবিদের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকে টাকা রেখে বিপদে পড়েছে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ তিনটি প্রতিষ্ঠান। দুর্বল ও অস্তিত্বসংকটে থাকা ব্যাংকে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ আছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা)। এ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রপ্তানি খাতের ভূমিকা সুদৃঢ় করা প্রতিষ্ঠান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) আছে ১৭৯ কোটি টাকা। বারবার তাগাদা দিয়েও অনিয়ম ও দুর্নীতিতে দুর্বল হয়ে পড়া ওইসব ব্যাংক থেকে এখন নিজস্ব তহবিলের টাকা উঠাতে পারছে না খোদ সরকারি এসব প্রতিষ্ঠান।
বিপিসির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের জুন শেষে বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির ২ হাজার ১৩২ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি আমানত রয়েছে। আর চলতি হিসাবে নগদ জমা রয়েছে ২৫ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। ব্যাংকের গচ্ছিত এ অর্থের বিপরীতে আলোচ্য সময়ে বিপিসির ১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা আয় হয়েছে সুদ বাবদ।
বেসরকারি খাতের ১১টি দুর্বল ব্যাংকে গত বছরের জুন শেষে বিপিসির অর্থ ছিল ২ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৭০১ কোটি, মেঘনা ব্যাংকে ২৮৫ কোটি, এসবিএসি ব্যাংকে ২১৯ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ২০৬ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ১৯৬ কোটি, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ১২৭ কোটি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ১২৯ কোটি, এক্সিম ব্যাংকে ২০২ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকে ১০৫ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ২০ কোটি ও পদ্মা ব্যাংকের কাছে ৬৫ লাখ টাকা গচ্ছিত রয়েছে।
এদিকে গত বছরের জুন শেষে নিট মুনাফায় থাকলেও সরকারি মালিকানাধীন আরেক প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের বিপরীতে ১৮৪ কোটি টাকা আয় হয়েছে। ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষে পেট্রোবাংলা বিভিন্ন ব্যাংকে ৩ হাজার ৪৭ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত রেখেছে। এ সময়ে ব্যাংকের চলতি হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির নগদ অর্থের পরিমাণ গচ্ছিত ছিল ৬ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ১০টি দুর্বল ব্যাংকে থাকা অর্থের পরিমাণ গত বছরের জুন শেষে ৯১৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এর মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংকের কাছে সবচেয়ে বেশি ৫৭০ কোটি টাকা রয়েছে। এ ছাড়া গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৯৮ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৯৬ কোটি, পদ্মা ব্যাংকে ৪১ কোটি, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ৩৪ কোটি, এসবিএসি ব্যাংকে ৩২ কোটি, এক্সিম ব্যাংকে ১৮ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ১৭ কোটি, মেঘনা ব্যাংকে প্রায় ৭ কোটি ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে ৩ কোটি টাকা। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) একেএম মিজানুর রহমান বলেন, ‘যেসব ব্যাংকে পেট্রোবাংলার স্বল্পমেয়াদি আমানত রয়েছে তার অনেকটিই নগদায়ন করা হয়েছে। যেসব ব্যাংকের তারল্য সংকট, সে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে অর্থ পেতে আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
সূত্র জানিয়েছে, ইপিবির ১৭৯ কোটি ৭২ লাখ ২২ হাজার ৯৬১ টাকা আটকে আছে ৯টি বেসরকারি ব্যাংক ও সরকারি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরেও উদ্ধার হচ্ছে না। সেসব প্রতিষ্ঠান হলো ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক এবং সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।
ইপিবি তিনটি তহবিলে ৫৯টি এককালীন স্থায়ী আমানত (এফডিআর) করেছে ওই ১০ প্রতিষ্ঠানে। তহবিল তিনটি হলোÑ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো প্রশাসনিক তহবিল, রপ্তানি বাজার উন্নয়ন তহবিল ও ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার তহবিল। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৭টি এফডিআরের মাধ্যমে ৪৬ কোটি ৯৮ লাখ ৩১ হাজার ৪৯৬ টাকা আটকে আছে ইউনিয়ন ব্যাংকের সাতটি শাখায়। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পাঁচটি শাখায় ১৩টি এফডিআরে আটকে আছে ৩৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ টাকা আটকে আছে আইসিবিতে।
এর একটি শাখায় তিনটি এফডিআরে আছে ৩১ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দুটি শাখায় চারটি এফডিআরে আটকে আছে ১৭ কোটি ৪১ লাখ ১৪ হাজার ১৪৬ টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের তিনটি শাখায় সাতটি এফডিআরে ১৭ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের দুটি শাখায় তিনটি এফডিআরে ৯ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চারটি শাখায় চারটি এফডিআরে সাত কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখায় পাঁচটি এফডিআরে ছয় কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংকের দুটি শাখায় দুটি এফডিআরে চার কোটি টাকা এবং পদ্মা ব্যাংকের একটি শাখায় একটি এফডিআরে আটকে আছে দুই কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইপিবির অর্থ ও হিসাব শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যেহেতু ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই ইপিবি সেখান থেকে টাকা তুলে নিতে চায়। কিন্তু ওইসব ব্যাংক এখন টাকা দিতে পারছে না। এর মধ্যে কেউ কেউ চাপে পড়ে শুধু লভ্যাংশ দিচ্ছে। কেউ বলছে, আবারও নবায়ন করতে; নবায়নের মেয়াদ শেষে একবারে দেবে। বেশির ভাগই এখন নিজেদের ব্যাংকের আর্থিক সংকটের কথা বলছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘কোনো আমানতকারীর টাকা হারাবে না। কয়েকটি ব্যাংকের একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রক্রিয়া শেষ হলে আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাবেন। পদ্মা ব্যাংকের জন্য একটি রোডম্যাপ করা হয়েছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী আমানত ফেরত দেওয়া হবে। এ জন্য তারল্য সহায়তা চাওয়া হয়েছে। গভর্নর বারবার বলেছেনÑ আমানতকারীরা তাদের টাকাই ফেরত পাবেন, তবে ধৈর্য ধরতে হবে।’