প্রশ্ন : অতীতের তুলনায় বর্তমানে বিমার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কী বাড়ছে?
উত্তর : অবশ্যই বলা যায় যে অতীতের তুলনায় বর্তমানে মানুষের মধ্যে বিমার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় বিমা খাতকে ঘিরে অনেক ভুল ধারণা ছিল, কিন্তু সময়ের পরিবর্তন, গ্রাহক সচেতনতার বৃদ্ধি এবং বেশকিছু সুনামধন্য কোম্পানির স্বচ্ছ সেবা প্রদানের ফলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হয়েছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর মানুষ বুঝতে পেরেছে যে জীবনের অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে বিমা হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর আর্থিক সুরক্ষা।
তবে এটাও সত্য যে, এখনো কিছু কোম্পানি দাবি নিষ্পত্তিতে উদাসীনতা বা বিলম্ব করছে, যা গ্রাহকের আস্থার জায়গাটিকে আঘাত করছে। এই ব্যতিক্রমগুলো পুরো শিল্পের ইমেজকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু ভালো দিক হলো-আজকের গ্রাহক অনেক বেশি সচেতন, তারা এখন কোম্পানির ট্র্যাক রেকর্ড যাচাই করে বিমা গ্রহণ করছে।
আমার বিশ্বাস, দাবি নিষ্পত্তিতে স্বচ্ছতা ও দ্রুততার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে খুব শিগগিরই বাংলাদেশে বিমার প্রতি মানুষের আস্থা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যেই ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, এখন শুধু সেটিকে আরও শক্তিশালীভাবে ধরে রাখার প্রয়োজন।
প্রশ্ন : দেশের জনসংখ্যার তুলনায় জীবন বিমা গ্রাহকের হার অতি নগণ্য। পার্শ্ববর্তী দেশসহ উন্নত বিশ্বে বিমা গ্রাহকের হার অনেক বেশি। বাংলাদেশের মানুষ বিমা গ্রহণে অনাগ্রহী কেন?
উত্তর: এটি সত্য যে বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় জীবন বিমা গ্রাহকের সংখ্যা এখনো নগণ্য। যেখানে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কায় বিমা গ্রহণকারীর হার অনেক বেশি, সেখানে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। এর পেছনে কয়েকটি মৌলিক কারণ রয়েছে-
১. সচেতনতার ঘাটতি: আমাদের দেশে এখনো সাধারণ মানুষ বিমাকে একটি প্রয়োজনীয় আর্থিক নিরাপত্তা হিসেবে নয়, বরং অনেক সময় অতিরিক্ত খরচ হিসেবে দেখে। বিমার সুফল সম্পর্কে গণসচেতনতা পুরোপুরি তৈরি হয়নি।
২. ভুল ধারণা ও অবিশ্বাস: অতীতে দাবি নিষ্পত্তি নিয়ে নানা জটিলতা ও দেরি হওয়ার কারণে অনেক মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। যদিও বর্তমানে অনেক কোম্পানি দ্রুত দাবি নিষ্পত্তি করছে, তবুও পূর্বের অভিজ্ঞতা মানুষের মনে প্রভাব ফেলছে।
৩. আর্থিক সীমাবদ্ধতা: দেশের একটি বড় অংশ নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষ। তাদের মধ্যে বিমার প্রিমিয়াম দেওয়ার সক্ষমতা সীমিত। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতেই যেখানে কষ্ট হয়, সেখানে ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য টাকা আলাদা করা অনেকের কাছে বিলাসিতা মনে হয়।
৪. শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা: উন্নত দেশে মানুষ আর্থিক পরিকল্পনায় অনেক বেশি মনোযোগী। বাংলাদেশে আর্থিক সাক্ষরতার ঘাটতি এখনো একটি বড় বাধা। ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারিত হলেও গ্রামীণ পর্যায়ে এখনো বিমা সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য পৌঁছায়নি।
৫. প্রচারণার দুর্বলতা: ব্যাংকিং সেক্টরের মতো বিমা খাতে এখনো সেই মাত্রায় গণমাধ্যমভিত্তিক প্রচারণা, ব্র্যান্ডিং ও আস্থা তৈরির উদ্যোগ হয়নি।
তবে ইতিবাচক দিক হলো- ক্রমশ মানুষ এখন পরিবর্তিত হচ্ছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধি, প্রযুক্তির প্রসার, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং বিশেষ করে মহামারির অভিজ্ঞতা মানুষকে শিখিয়েছে বিমা কতটা জরুরি। এ কারণে বলা যায়, সঠিক উদ্যোগ, গ্রাহকবান্ধব নীতি এবং স্বচ্ছ দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশেও জীবন বিমা গ্রহণের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
প্রশ্ন : ব্যাংকাস্যুরেন্সের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কতটুকু দেখছেন?
উত্তর: বাংলাদেশে ব্যাংকাস্যুরেন্সের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাংকাস্যুরেন্স প্রমাণ করেছে যে এটি বিমা খাতের বিস্তৃতি ও আস্থা বৃদ্ধির সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। ব্যাংক হলো জনগণের নিকট সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি উপজেলায় এবং ইউনিয়ন পর্যায়েও ব্যাংকের শাখা বিস্তৃত রয়েছে। এই বিশাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিমা সেবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সহজে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে বিমা বিক্রি হলে গ্রাহকরা একদিকে নিরাপদ মনে করবেন, অন্যদিকে সহজেই এক জায়গায় ব্যাংকিং ও বিমা, দুটি সেবাই গ্রহণ করতে পারবেন। এটি গ্রাহকের জন্য সুবিধাজনক, ব্যাংকের জন্য লাভজনক এবং বিমা শিল্পের জন্য যুগান্তকারী একটি উদ্যোগ হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সঠিক নীতিমালা ও কাঠামো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যাংকাস্যুরেন্স আগামী দিনে বাংলাদেশের বিমা খাতের প্রবৃদ্ধি ও গ্রাহক আস্থার নতুন দ্বার উন্মোচন করবে
প্রশ্ন : বিমা দাবি পরিশোধ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন উল্লেখ করুন।
উত্তর: আমার কাছে বিমা শিল্পের মূল শক্তি হলো দাবি নিষ্পত্তি। কারণ গ্রাহক বিমা গ্রহণ করেন তার ও তার পরিবারের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। তাই যখন কোনো দুর্যোগ বা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি আসে, তখন যদি তিনি দ্রুত এবং যথাযথভাবে দাবি নিষ্পত্তি পান, তখনই তার মনে বিমার প্রতি আস্থা দৃঢ় হয়। অন্যদিকে দাবি নিষ্পত্তিতে দেরি বা জটিলতা দেখা দিলে তা পুরো খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে।
আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, গত কয়েক বছরে প্রগতি লাইফ ধারাবাহিকভাবে উচ্চ হারে দাবি নিষ্পত্তি করেছে। বৈধ দাবি নিষ্পত্তির হার এবং গ্রাহকের সন্তুষ্টির দিক থেকে আমাদের অবস্থান শীর্ষ কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম। শুধু তাই নয়, প্রযুক্তিনির্ভর সিস্টেম চালু করার ফলে এখন দাবি প্রক্রিয়া আরও সহজ, দ্রুত ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে।
ফলে বলা যায়, দাবি নিষ্পত্তি ক্ষেত্রে প্রগতি লাইফের সাফল্যই আমাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু এবং গ্রাহক আস্থার মূল ভিত্তি। আমি বিশ্বাস করি, এ ধারা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে আমরা শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানেরই নয়, বরং পুরো বিমা শিল্পের ভাবমূর্তিকে আরও শক্তিশালী করতে পারব।
প্রশ্ন : সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আপনার প্রতিষ্ঠানের বিমার সংখ্যা, পরিশোধিত দাবির সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ, দাবি নিষ্পত্তির হার, সম্পদের পরিমাণ ও বর্তমান বিনিয়োগ কত?
উত্তর : প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসির সর্বশেষ ২০২৪ অর্থবছর অনুযায়ী: মোট পলিসির সংখ্যা: প্রায় ৬,৯৬,৪৪৭ টি (গ্রুপবিমা সহ), সর্বশেষ অর্থবছরে পরিশোধিত দাবি সংখ্যা: ১৪৬,২০৬টি, পরিশোধিত দাবির পরিমাণ: ৩,৮৮৮,৭৩৬,৫০০ টাকা, দাবি নিষ্পত্তির হার: ৯৯.৮৫%, প্রতিষ্ঠানের মোট সম্পদের পরিমাণ: ৭,৪৬৭,৭৬১,৪৯৩ টাকা, বর্তমান বিনিয়োগ: ৫,১৩৩,৬১৪,৭০৬ টাকা।
প্রশ্ন : বিমা খাতের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে কী কী ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : বিমা খাতকে এগিয়ে নিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি
১. কঠোর মনিটরিং ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। ২. দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া দ্রুত ও গ্রাহকবান্ধব করা। ৩. ডিজিটালাইজেশন ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বাধ্যতামূলক করা। ৪. ব্যাংকাস্যুরেন্স সহজতর করা। ৫. গ্রাহক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রচারণা চালানো। ৬. বিমা এজেন্টদের প্রশিক্ষণ ও মান উন্নয়ন। এগুলো বাস্তবায়ন হলে বিমা শিল্পে আস্থা ও অংশগ্রহণ উভয়ই বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
মো. জালালুল আজিম
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও
প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি