বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আরও বেড়েছে; গ্রস বা মোট হিসাবে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ফের ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছাড়িয়েছে ২৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন গত রোববার বাংলাদেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩০ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার; বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। গত বুধবার দিন শেষে মোট রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ৩১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ২৬ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন এ তথ্য জানিয়ে বলেন, মূলত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে রিজার্ভ বাড়ছে। বেশ কিছুদিন ধরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিল রিজার্ভ। এখন এই সূচক সন্তোষজনক অবস্থায় এসছে। হুন্ডি কমে যাওয়ার কারণেই রেমিট্যান্স বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে হুন্ডি কমে গেছে। এখন দেশে যে রেমিট্যান্স আসছে, তার পুরোটাই বৈধ পথে অর্থাৎ, ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে। আর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতির কারণেই রিজার্ভ বাড়ছে। অর্থনীতিতেও স্বস্তি ফিরছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হিসেবে দাবি করে।
সবশেষ গত জুন মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২৬ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। গত ৮ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে আকুর মে-জুন মেয়াদের ২ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করে। এরপর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। গ্রস হিসাবে নামে ২৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে। আকুর দেনা শোধের আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। আর গ্রস হিসাবে ছিল ৩১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে; তখন অবশ্য রিজার্ভ বেশ খানিকটা কমে আসবে। আকু হলো এশিয়ার কয়েকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যকার আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তির ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, তার মূল্য প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি করা হয়। আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। এর মধ্যে ভারত পরিশোধ করা অর্থের তুলনায় অন্য দেশগুলো থেকে বেশি পরিমাণে ডলার আয় করে। অন্যদিকে বেশির ভাগ দেশকেই আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় হিসাবে অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হয়। ব্যাংকগুলো আমদানি খরচ নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেয়, যা রিজার্ভে যোগ হয়। তবে ওই দায় দুই মাস পরপর রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করে দেওয়া হয়।
ডলারের দাম ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিলামে ডলার কেনার কারণেও রিজার্ভ বাড়ছে বলে জনিয়েছেন ব্যাংকাররা। গত এক মাসে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৭৬ কোটি ২০ লাখ ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থনীতির সামর্থ্য প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চলছে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় থেকেই। অভ্যুত্থানের পর গত বছর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও উদ্বেগ কাটছিল না। রেমিট্যান্স ছাড়াও রপ্তানি আয় এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্যান্য দাতা সংস্থার বাজেট সহায়তার ঋণে রিজার্ভ স্বস্তিকর জায়গায় এসেছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণের কারণে গত জুন শেষে গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৩১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার হয়, ২৮ মাসের মধ্যে যা ছিল সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২৩ সালের মার্চের শুরুতে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছিল। গত জুন শেষে বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ওঠে ২৬ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালের জুন থেকে আইএমএফের শর্ত মেনে বিপিএম৬ অনুযায়ী হিসাব প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২১ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ (তখন বিপিএম-৬ হিসাবে প্রকাশ করা হতো না) ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। সেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে কমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে গত জুলাই শেষে ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে নেমেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্থ পাচারে কঠোর নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন কারণে ডলারের প্রবাহ বেড়েছে। হুন্ডি ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত রবিবার রেমিট্যান্সের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের প্রথম ২৩ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানলে ১৭৫ কোটি (১.৭৫ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের ১ মাস ২৩ দিনে (১ জুলাই থেকে ২৩ আগস্ট) এসেছে ৪২২ কোটি ৬৫ লাখ (৪.২৩ বিলিয়ন) ডলার, যা গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। বলা যায়, সংকটে পড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে রেমিট্যান্স।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩২ কোটি ৭৫ লাখ (৩০.৩৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। প্রতি মাসের গড় হিসাবে এসেছিল ২৫১ কোটি ৯৮ লাখ (২.৫২ বিলিয়ন) ডলার।
রোজা ও ঈদ সামনে রেখে গত মার্চে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ (৩.২৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে, যা ছিল গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯৬ কোটি ৯৬ লাখ (২.৯৭ বিলিয়ন) ডলার আসে গত মে মাসে। তৃতীয় সর্বোচ্চ আসে গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে, ২৮২ কোটি ১২ লাখ (২.৮২ বিলিয়ন) ডলার। চতুর্থ সর্বোচ্চ আসে এপ্রিল মাসে, ২৭৫ কোটি ১৯ লাখ (২.৭৫ বিলিয়ন) ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৯১ কোটি ২২ লাখ (২৩.৯১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছিল ২২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে আসে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন