রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় একটি বিমা কোম্পানির অফিসে ঢুকতেই শোনা যায় একজন ক্ষুব্ধ গ্রাহকের কণ্ঠ। তিনি অভিযোগ করেন, বিমা দাবির টাকা পেতে মানুষ ঘুরে ঘুরে হয়রান হচ্ছে, তবু টাকা পাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা জানান, ২০২১ সালে মেয়াদ শেষ হওয়া একটি বিমার টাকা এখনো গ্রাহক পাননি। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বিপর্যস্ত, তাই নতুন কোনো পলিসি নেওয়া হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি শুধু এক বা দুই গ্রাহকেই নয়, আরও কয়েকজন জানান, বিমার কিস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৪-৭ বছর ধরে তারা টাকা পাননি। সহজ করে বললে, বছরের পর বছর বিমা কোম্পানির দরজায় ঘুরেও টাকার দেখা পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা। একসময় ভবিষ্যতের ভরসা ছিল এই খাত, এখন সেটিই পরিণত হয়েছে আস্থাহীনতার প্রতীকে। দেশের বিমা কোম্পানিগুলোর কাছে গ্রাহকদের আটকে আছে ৭ হাজার কোটি টাকা, অথচ বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি পরিশোধ করছে না।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্যমতে, ৭৫টি জীবন ও সাধারণ বিমা কোম্পানির মধ্যে অনেকে বছরের পর বছর গ্রাহকের দাবি ঝুঁলিয়ে রেখেছে। বিমা আইন অনুযায়ী মেয়াদপূর্তির ৯০ দিনের মধ্যে দাবি পরিশোধ বাধ্যতামূলক, কিন্তু বাস্তবে সেই নিয়ম কাগজেই সীমাবদ্ধ। অর্থ লোপাট, অদক্ষ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট ও অপরিপক্ব বিনিয়োগে জর্জরিত বিমা খাত এখন গভীর আর্থিক সংকটে। গ্রাহক দাবি পরিশোধ না করতে পারায় ব্যাবসায়িক আস্থা কমছে, নতুন গ্রাহকও বিমুখ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট সাঈদ আহমেদ স্বীকার করেছেন, ‘লাইফ ও নন-লাইফের বেশ কিছু কোম্পানিতে অর্থ লোপাট হয়েছে। এ কারণে এখন কোম্পানিগুলো অর্থ সংকটে ভুগছে এবং গ্রাহকের দাবি মেটাতে পারছে না।’ তিনি বলেন, ‘কয়েকটি কোম্পানির জন্য সবাই বিমা খাতকে ঘৃণা করছে। বিমার নাম শুনলেই মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি পাল্টানোর চেষ্টা করছি। যারা টাকা নিয়ে পালিয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় এনে অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’
বিশ্লেষকদের মতে, বিমা খাতের দুরবস্থার পেছনে রয়েছে চারটি মূল কারণ অর্থ লোপাট, ব্যর্থ বিনিয়োগ, নীতিগত অবহেলা ও ইচ্ছাকৃত অর্থ আটকে রাখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মাইন উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ব্যাংকের মতোই বিমা খাতে আর্থিক লোপাটের বড় জায়গা তৈরি হয়েছে। অদক্ষ বিনিয়োগ ও মেরে খাওয়ার প্রবণতা এ খাতকে ধ্বংস করছে।’
আইডিআরএর তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ৮২টি বিমা কোম্পানি রয়েছে; যার ৩৬টি জীবন বিমা ও ৪৬টি সাধারণ বিমা। এর মধ্যে জীবন বিমা কোম্পানিগুলো ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে দাবি পরিশোধ করেছে মাত্র ৩৫ শতাংশ, আর সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এই হার ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রায় ৯২ শতাংশ দাবি এখনো ঝুলে আছে।
সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে সরকারি সাধারণ বিমা করপোরেশন (এসবিসি), গ্রাহক পাওনা ২ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। এরপর গ্রিন ডেল্টার ২৭০ কোটি, প্রগতির ১৬৪ কোটি, রিলায়েয়েন্সের ১০১ কোটি ও পিপলস ইনস্যুরেন্সের ৮১ কোটি। এভাবে মোট ৪৬টি নন-লাইফ কোম্পানির কাছে পাওনা ৩ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার মধ্যে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ৩০০ কোটি, অর্থাৎ এখনো ৯২ শতাংশ দাবি অনিষ্পন্ন।
নন-লাইফ বিমার এই অবস্থার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালিকদের অর্থ আটকে রাখার মানসিকতা, গ্রাহকের অসম্পূর্ণ কাগজপত্র, সার্ভে রিপোর্টে বিলম্ব, এসবিসি থেকে পুনর্বিমার অর্থ ফেরত না পাওয়া এবং বিনিয়োগের ভুল সিদ্ধান্ত সবকিছু মিলিয়ে এ সংকট তৈরি হয়েছে। এক বিমা কোম্পানির সিইও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নন লাইফ বিমায় বছরের শেষে হিসাব বন্ধ হয়ে যায়, মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এরপর বড় কোনো দাবি এলে সেটি পরিশোধের অর্থ থাকে না।’
অন্যদিকে, দেশের ৩৬টি জীবন বিমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকের দাবি উঠেছে ৫ হাজার ৫৭৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যার মধ্যে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৯৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ফলে বকেয়া রয়ে গেছে ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যার পুরোটাই ২৯ বিমা কোম্পানির। গ্রাহকদের টাকা না দেওয়ার শীর্ষে রয়েছে ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স, যার কাছে পাওনা ২ হাজার ৭৪২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। দ্বিতীয় স্থানে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ২৪৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এরপর রয়েছে প্রগ্রেসিভ লাইফের ১৫৫ কোটি, মেটলাইফ বাংলাদেশের ৮৪ কোটি ও বায়রা লাইফের ৭৯ কোটি টাকা। বিমা বিশ্লেষক এস এম জিয়াউল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘লাইসেন্স টিকিয়ে রাখতে হলেও বিমা দাবি দ্রুত পরিশোধ করা দরকার। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা এবং সদিচ্ছার অভাবে কোম্পানিগুলো দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। আইডিআরএ কঠোর হলে কেউ দাবি পরিশোধ না করে পারত না।’ এ অবস্থায় আইডিআরএ বলছে, তারা খাতের অস্থিরতা দূর করতে পদক্ষেপ নিয়েছে।
এরই মধ্যে ১৫টি বিমা কোম্পানির বিশেষ অডিট শুরু হয়েছে। অডিটে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কেন তারা সময়মতো দাবি মেটাতে পারছে না এবং কীভাবে বকেয়া পরিশোধ করা যায়। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিআরএর চেয়ারম্যান আসলাম আলম বলেন, ‘বেশ কিছু কোম্পানি নিয়ম মানছে না, দাবি সময়মতো দিচ্ছে না। এতে খাতে ভয়াবহ আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে বিমা খাতে স্বস্তি ফিরবে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন