ঢাকা বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৫

ছাপা পত্রিকার সুদিন আবার ফিরবেই

রেজানুর রহমান
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২৫, ১২:১০ এএম

নিকেতনে আমি যে বাড়িতে ভাড়া থাকি সেই বাড়িতে মোট ১৬টি ফ্ল্যাট। অর্থাৎ ১৬টি পরিবারের বসবাস এই বাড়িতে। একদিন হঠাৎ একটা বিষয়ে জানার কৌতূহল হলো। দেখি তো ১৬টি পরিবারের মধ্যে দৈনিক পত্রিকা রাখে কয়টি পরিবার। সকালে একজন তরুণ সাইকেল চালিয়ে এলো। সে বিভিন্ন বাসায় পত্রিকা সরবরাহ করে। তরুণের নাম মকবুল। সাইকেল চালিয়ে এসে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা আমার ভাড়াবাড়ির প্রধান ফটকের সামনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই দ্রুতগতিতে সাইকেল চালিয়ে অন্য বাড়ির দিকে চলে গেল। 
আমার ভাড়াবাড়ির দারোয়ানের নাম সুলতান। ইতোমধ্যে পত্রিকাগুলো তুলে নিয়েছে। আমি নিয়মিত দুটি পত্রিকা পড়ি। একটি বাংলা, অন্যটি ইংরেজি। এ নিয়ে আমার পরিবারে অনেক আপত্তি। মোবাইল ফোনে সবই দেখা যায়। পত্রিকাও পড়া যায়। কাজেই দুটি পত্রিকা রাখার দরকার কী? আমি এ যুক্তি মানতে নারাজ। মোবাইল ফোনে যত সহজেই পত্রিকা পড়া যাক না কেন আমার মন ভরে না। ছাপা পত্রিকার গুরুত্ব অন্যরকম। পত্রিকা পড়ার সময় একটি সম্পর্ক তৈরি হয়। সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো। অথবা অভিভাবকের মতো। একটি পত্রিকায় কত যে খবর থাকে। ভালো খবর, মন্দ খবর। সাফল্যের খবর, রাজনীতির খবর। ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা, নাটক, সিনেমা এমন কী রান্নাবান্না, ভ্রমণবিষয়ক খবরও থাকে। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার প্রতিই আমার আকর্ষণ বেশি। দৈনিক ইত্তেফাকে একটানা ১৯ বছর সাংবাদিকতা করেছি। তখনকার দিনে দৈনিক পত্রিকার ক্ষেত্রে ইত্তেফাকের বিকল্প ছিল না। দেশসেরা এমন একটি ঐতিহ্যম-িত দৈনিকে সাংবাদিকতা শুরু করার সুযোগ পেয়ে আমার জীবনের গতিপথই বদলে যায়। ১৯ বছর পর ইত্তেফাক ছেড়ে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের দেশসেরা বিনোদন পাক্ষিক আনন্দ আলোয় প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হই। সঙ্গতকারণে ছাপা পত্রিকার প্রতিই আমার দুর্বার আকর্ষণ। মোবাইল ফোনে পত্রিকা পড়ে আনন্দ পাই না। কিন্তু আমার পরিবারের সদস্যরা একটু ভিন্ন মেজাজের। মোবাইল ফোনই যেন তাদের দুনিয়া। মোবাইলে খায়, মোবাইলেই ঘুমায় এমন অবস্থা। 
আসল কথায় আসি। সুলতানের হাতে ভাঁজ করা কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা। আমার হাতে নির্ধারিত দুটি পত্রিকা তুলে দিল সে। গুনে দেখি তার হাতে রয়েছে মাত্র ৪টি দৈনিক পত্রিকা। দেশের জনপ্রিয় একটি দৈনিকের ৩ কপি, আরেকটি ধর্মীয় আদর্শকে বিকশিত করার নিমিত্তে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক। অংকটা একটু গোলমেলে মনে হলো। ১৬টি পরিবারের মধ্যে মাত্র ৪টি পরিবার ছাপানো দৈনিক পত্রিকা পড়ে। এটা কী শুভ সংবাদ? মোটেই না। 
১৬-এর মধ্যে এই যে ১২টি পরিবার দৈনিক পত্রিকা কিনে না, তা হলে এই পরিবারগুলো কী দৈনিক পত্রিকা পড়েই না? না, ১২টি পরিবারই যে দৈনিক পত্রিকা পড়ে না একথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ পত্রিকা পড়ার তো এখন অনেক মাধ্যম। অনলাইন তার মধ্যে একটি মাধ্যম। যারা ছাপা পত্রিকা পড়ে না তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো অনলাইন পত্রিকা পড়ে। কাজেই হতাশ হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। এই যে হতাশ হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি কথাটা বললাম এটা কি কথার কথা? একটু বিশ্লেষণ প্রয়োজন। 
আমরা যে সময়টাকে ছাপা পত্রিকার স্বর্ণযুগ বলি তখন কী কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল? না ছিল না। দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল খুবই কম। টিভি চ্যানেল ছিল মাত্র একটি। কাজেই খোদ ঢাকা শহরে কোনো ঘটনা ঘটলেও তার খবর মিলত পরের দিনের দৈনিক পত্রিকায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর পেতে কয়েকদিন লাগত। আর এখন শুধু দেশে নয়, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের খবর বোধকরি বাতাসের আগে ছুটে আসে মোবাইল ফোনে। কাজেই আগের দিনের মতো পাঠককে দৈনিক পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। আমার মেয়ে জার্মানিতে পড়াশোনা করে। মাঝে মাঝে ওর ফোন পেয়ে অবাক হই। দেশের কোনো ঘটনা আমি হয়তো জানি না। অথচ সুদূর জার্মানিতে বসে সে খবরটা জানিয়ে দেয়। বাবা, খবর পেয়েছ? আজ কিন্তু এ ঘটনা ঘটেছে... কী করে এটা সম্ভব? ওই যে বললাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বদলে দিয়েছে আমাদের দিন যাপনের নিয়ম-কানুন। তথ্যকে করে দিয়েছে সহজলভ্য। এমন বাস্তবতায় ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ কী? সেটা বেশ ভাবনার বিষয়। 
তবে এ ব্যাপারে আমি মোটেই শঙ্কিত নই। যারা বলেন, ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে তারা সঠিক বলছেন না। আমি বরং মনে করি ছাপা পত্রিকার পাঠক দিনে দিনে বাড়ছে। চ্যানেল আইতে আমি প্রতিদিন সকালে ‘সংবাদপত্রে বাংলাদেশ’ নামে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করি। রাতে একই টিভি চ্যানেল একই ধারার আরেকটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। অন্যান্য টিভি চ্যানেলে দৈনিক পত্রিকা নিয়ে একই ধারার অনুষ্ঠান প্রচার হয় নিয়মিত। দেশ-বিদেশের প্রচুর দর্শক সংবাদপত্রবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো দেখেন। দৈনিক পত্রিকার প্রতি আকর্ষণ না থাকলে এ ধরনের অনুষ্ঠান মোটেই জনপ্রিয় হতো না। এর থেকে বোঝা যায় দৈনিক পত্রিকার পাঠক কমেনি বরং বেড়েছে। 
তবে হ্যাঁ, সময়ের বাস্তবতায় দৈনিক পত্রিকাগুলোকে প্রতিদিন কঠিন, কঠোর বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আগের দিনে তথ্য অর্থাৎ সংবাদ খুঁজে বের করতে হতো। এখন সংবাদ নিজেই হাজির হয়। নিজেই বলে আমাকে গুরুত্ব দাও। প্রকাশ কর। তবে সব সংবাদই কিন্তু সংবাদ নয়। এই যে কোনটা সংবাদ কোনটা সংবাদ নয়, সেটা বুঝে নেওয়ার তাৎক্ষণিক ক্ষমতা যার যত বেশি তার বা তাদের পক্ষে একটি পাঠকপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করা খুবই সহজ। 
অনেকে হয়তো আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন। তবুও বলি। আমাদের দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র রাজনৈতিক খবরের ওপরই নির্ভরশীল। কোনো কোনো পত্রিকা তো বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের মতাদর্শকে গুরুত্ব দেয়। এ ধরনের পত্রিকার পাঠক কম হবে এটাই বাস্তবতা। 
আরেকটি কথা না বললেই নয়। বর্তমান বাস্তবতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চ্যালেঞ্জকে উপেক্ষা করেই পত্রিকা প্রকাশের দুরন্ত সাহস দেখানো জরুরি। সেখানে সত্যনিষ্ঠ সংবাদ গুরুত্বের দাবি রাখে। দেশের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা বাদে অন্যরা যেন গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলেন। একটি পত্রিকা থাকতে হবে, পত্রিকা থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখাতে সুবিধা হয়। রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধাও মিলবে, কারও কারও এমনই মানসিকতা। এটাকে সৎ উদ্দেশ্য বলে না। 
কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা বাদে অন্য দৈনিক পত্রিকাগুলো সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রেও তেমন আন্তরিক নয়। অনেক পত্রিকায় মাসের বেতন মাসে হয় না। এমন অনিশ্চয়তায় সাংবাদিকতা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বস্তুনিষ্ঠ, শুদ্ধ সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটছে না। সে কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কছে দৈনিক পত্রিকাগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্ভাবনার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে। 
তবে এটাকে আমি হুমকি মনে করি না। আমাদের একটা কথা ভাবতে হবে, সময় বদলেছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর যুগে বদলে গেছে অনেক কিছুই। সেখানে ছাপা পত্রিকার কাক্সিক্ষত বদলটা ঘটেনি। ছোট একটা উদাহরণ দেই। চ্যানেল আইতে সংবাদপত্রের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে প্রায়শই আমি একটা সংকটের মুখোমুখি হই। তা হলো সংবাদের প্রকৃত আপডেট না থাকা। ইদানীং অধিকাংশ দৈনিক পত্রিকা কর্তৃপক্ষ রাত ৮টা-৯টার মধ্যে পত্রিকা প্রকাশের জরুরি কাজ শেষ করেন। ফলে রাত ১১টা-১২টায় দেশে-বিদেশে যে খবর তৈরি হয় তা অধিকাংশ দৈনিকে পাওয়া যায় না। সকালে পাঠকের হাতে যখন পত্রিকা পৌঁছায় তখন জরুরি কোনো খবরের ক্ষেত্রে পাঠকের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একটি উদাহরণ দিতে চাইÑ বাংলাদেশ বনাম আফগানিস্তানের ক্রিকেট লড়াই চলছিল। ওয়ানডে ম্যাচ। খেলার প্রথমার্র্ধে বাংলাদেশ বেশ ভালোই খেলে। অধিকাংশ পত্রিকা শিরোনাম ছাপে জয়ের প্রান্তে বাংলাদেশ। অথচ বাংলাদেশ এ খেলায় হেরে যায়। এই যে প্রকৃত সংবাদ ছাড়াই পত্রিকাটি পাঠকের হাতে গেল এর পরও কী আমরা আশা করব পাঠক হুমড়ি খেয়ে ছাপা পত্রিকা পড়বে? নন্দিত নাট্যকার পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের টিভি নাটক পছন্দ করেন না এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে বর্তমান বাস্তবতায় নিজেকে বদলাতেন নিশ্চয়ই। তেমনই সময় বিবেচনায় দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর বদল প্রয়োজন। 
আমি আশাবাদী। ছাপা পত্রিকার প্রতিই পাঠক আবার আগের দিনের মতোই আগ্রহী হয়ে উঠবে। কারণ ছাপা পত্রিকা পড়ার ক্ষেত্রে যে শান্তি পাওয়া যায় ডিজিটাল প্রযুক্তি সে শান্তি দিতে পারে না। চেখের আনন্দই বড় আনন্দ। মোবাইলে  পত্রিকা পড়ে চোখ সে আনন্দ পায় না। ছাপা পত্রিকা চোখকে সেই আনন্দ দেয়। আশায় আছি- ছাপা পত্রিকার সেই সুদিন আবার ফিরবে। আশা আছে বলেই মানুষ বাঁচে...

লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো