সংবিধান একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং নীতিমালা নির্ধারণকারী দলিল, যা জনগণের অধিকার, রাষ্ট্রকাঠামো, ক্ষমতা বণ্টন এবং সরকারের কর্তব্য নির্ধারণ করে। বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও জনগণের প্রত্যাশার আলোকে প্রণীত হলেও, তার কার্যকর বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও স্বৈরতান্ত্রিক প্রভাবের কারণে সীমিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে ’৭২ সালের সংবিধান, তার উল্লেখযোগ্য সংশোধনী এবং তার প্রভাব সংক্ষেপে আলোচিত হয়েছে।
সব সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মূল বাংলাপাঠ এবং ইংরেজিতে অনূদিতপাঠÑ স্পিকার কর্তৃক নির্ভরযোগ্য বলে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর ’৭২-এর সংবিধান স্পিকার কর্তৃক প্রমাণীকৃত হয়। ১৫ ডিসেম্বর হাতে লেখা সংবিধানে গণপরিষদের সদস্যগণ স্বাক্ষর প্রদান করেন এবং মধ্যরাতেই বাংলাদেশ গণপরিষদ ভেঙে দেয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর ’৭২ থেকে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ১টি প্রস্তাবনা, ১১টি ভাগ ও ১৫৩টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত।
সংবিধান হচ্ছে জনগণের গৃহীত সেই দলিল, যাতে জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণে রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ, রাষ্ট্রকাঠামো, সরকার পদ্ধতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার ও বণ্টন নীতি এবং সর্বোপরি জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাক্সক্ষা ও বহু লড়াই-সংগ্রাম এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বিকশিত চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমনÑ ’৭২-এর সংবিধানে
ক) স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ‘সাম্য’ ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক সুবিচার’Ñ এই তিনটি আদর্শকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
খ) ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ক্ষমতাকাঠামো অক্ষত রাখার কারণে গণমুখী ও প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের পরিবর্তে প্রকৃতপক্ষে স্বৈরতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ প্রতিস্থাপিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
গ) সংবিধানের কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয়নি এবং বঙ্গবন্ধুর অবদানের কোনো স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি।
ঘ) বাংলাদেশকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে অর্থাৎ জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে গত ৫৪ বছর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
ঙ) সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য এমনকি ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঠাঁই পায়নি।
’৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির পাশাপাশি মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন-সমাবেশ করার স্বাধীনতা, বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্ত থাকা, সকলের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমতা ইত্যাদি বিষয় প্রথম থেকে তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সব ভালো ভালো বিষয় উল্লেখ থাকলেও সংবিধানের অন্তর্নিহিত ‘বৈপরীত্য’ এবং ‘গোলকধাঁধা’ বিদ্যমান থাকায় তার অনেক কিছুই কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ফলে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা এবং জনগণের ক্ষমতা মূলত ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে। সুতরাং বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান এবং তার বদৌলতে দেশে যেধরনের শাসনব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা বিরাজমান রয়েছে বিশেষ করে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের প্রশ্নে এবং আইন-কানুনের চরিত্র ও প্রয়োগের প্রশ্নে স্বল্প পরিসরে তা পর্যালোচনা সম্ভব নয়।
এখন পর্যন্ত সংবিধান ১৭ বার সংশোধিত হয়েছে। এই সংশোধনীগুলোকে কয়েকটি কালপর্বে ভাগ করা যায়Ñ
ক) ’৭১ থেকে ’৭৫ পর্ব,
খ) সামরিক শাসন পর্ব,
গ) ’৯০-পরবর্তী পর্ব।
১৯৭৩ সালে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ও দ্বিতীয় সংশোধনী আনয়ন করা হয়। প্রথম সংশোধনী আনয়ন করা হয় গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের বিচারের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। যাতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তগণ কোনো আইনকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে না আসতে পারে, তার জন্য অনুচ্ছেদ ৪৭(২), ৪৭(৩) ও ৪৭(ক) যুক্ত করা হয়।
১৯৭৩ সালে গণতান্ত্রিক সংবিধানের চরিত্র বদল করার উদ্যোগ নেওয়া হয় দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে। ফলে সংবিধান মৌলিক অধিকারের অঙ্গীকার থেকে সুস্পষ্টভাবে সরে আসে এবং সংবিধানের আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই সংশোধনীতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ব্যবস্থা সংবলিত ১৪১(ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে মৌলিক অধিকার পরিপন্থি আইন বিশেষ করে উচ্চ আদালতের ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং জনগণের মৌলিক মানবাধিকার স্থগিত রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
তৃতীয় সংশোধনী হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি কার্যকর করার উদ্দেশ্যে প্রণীত আইন।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়, যার মাধ্যমে ’৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করা হয়। এ ভয়াবহ সংশোধনী বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় অল্প সময়ে বিনাতর্কে সংসদে গৃহীত হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় মন্ত্রিপরিষদ সরকারের বদলে রাষ্ট্রপতি শাসিতব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। বিচারপতি নিয়োগ এবং বরখাস্তের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতির অপসারণের জন্য সংসদের তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের ভোটে পাস হওয়ার শর্তযুক্ত করা হয়। সংবিধানে ষষ্ঠ(ক) ভাগ সংযুক্তিপূর্বক সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক দল চালু করার ব্যবস্থা করা হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্তদের একদলীয় শাসনব্যবস্থার জাতীয় দলে সদস্য হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। একদল ছাড়া অন্য সব দলের রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ সংশোধনীতে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ উল্লেখ করা হয় এবং বিনা নির্বাচনে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য বঙ্গবন্ধুকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই চতুর্থ সংশোধনীতেই সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। সরকারকাঠামোর পরিবর্তন, সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধি ইত্যাদি প্রশ্নে জনগণের মতামত নেওয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করেনি।
চতুর্থ সংশোধনী জাতীয় রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলেছে, জাতীয় রাজনীতির গতিপথ কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছেÑ তা বলার জন্য বড় পরিসর প্রয়োজন। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমেই সংবিধান কতটা অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারি দলের আজ্ঞাবাহীÑতা প্রমাণিত হয়েছে। এই সংবিধান যে কাঠামোগতভাবেই গণবিরোধী, তা ’৭৫ সালেই উন্মোচিত হয়েছে। একদলীয় বাকশাল এবং চতুর্থ সংশোধনীর ফলে ’৭২-এর সংবিধানের মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে।
এরপর আসে সামরিক শাসন পর্ব। পঞ্চম সংশোধনীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যকার যাবতীয় সামরিক ফরমান, আদেশ ঘোষণা ও ইত্যাদি দ্বারা কৃতকর্মকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ সামরিক আইন জারি করেন। সামরিক আইন জারি করার সময় সংবিধান স্থগিত বা বাতিল করেননি। জাতীয় সংসদও বহাল ছিল। এই অদ্ভুত আইনের প্রবর্তক আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক। সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয় ১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর। উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার যাতে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করতে পারেন এ জন্য এই সংশোধনী আনা হয়।
সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়া হয়। তারপর অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম অন্তর্ভুক্ত হয়। নবম সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা এবং দশম সংশোধনীতে সংরক্ষিত নারী আসন অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পরবর্তী সময়ে গণআন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তর ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীকে অবৈধ বলা হয়েছে আর রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য আন্দোলনকারীদের বৈধ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ আইন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শেষে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে পূর্ববর্তী পদ অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদে প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা দেয়।
দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বদলে আবার সংসদীয় পদ্ধতির সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থা ফেরত আনা হয়। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অর্থাৎ জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা হয় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। চতুর্দশ সংশোধনীতে নারীদের জন্য সংসদে ৪৫টি সংরক্ষিত আসন রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে সাংবিধানিক সংকটগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তড়িঘড়ি করে ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেওয়ার পর, সরকারÑ তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে।
আওয়ামী লীগ সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনে সংবিধান ও গণতন্ত্রের ভিত্তি কাঁপিয়ে দেয়। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের আলোকে পঞ্চদশ সংশোধনী আনয়ন করা হয়নি। ফলে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে সরকার নির্বাচনকে ক্ষমতা ধরে রাখার উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকে মূলত প্রহসনে পরিণত করেছে এবং জনগণকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে বহু অনুচ্ছেদ সংশোধনের অযোগ্য বা অপরিবর্তনীয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানের সার্বভৌমত্বকেও ধ্বংস করে দিয়েছে, যা আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ।
১৬তম সংশোধনী ছিল বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত, এর মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়, যা আপিল বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করেছে। ১৭তম সংশোধনীতে আরও ২৫ বছরের জন্য জাতীয় সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধান সংস্কারের যে-প্রস্তাবনা, তার জন্য আমাদের আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত অর্থাৎ সংবিধানের ১৮তম সংশোধনীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
ব্যক্তি এবং দলীয় স্বার্থে সংবিধান বহুবার সংশোধিত হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধান মূলত সরকারের অধীন। সংবিধানের দোহাই দিয়ে যে কোনো অগণতান্ত্রিক কাজ পরিচালনা করা যায়। কোনো নাগরিকের অধিকার বা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার সক্ষমতা এ সংবিধানের নেই। বর্তমান সময়ে সাংবিধানিক সার্বভৌমত্বও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে অপসারিত হয়েছে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা নিরাপত্তা অহরহ লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই সংবিধান জনগণের অভিপ্রায় পূরণের সহযোগী নয়, বরং স্বৈরতান্ত্রিক এবং প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতা প্রয়োগের অস্ত্র মাত্র।
এই প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলোÑ সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধন করা। সরকার ইতোমধ্যেই ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর আলোকে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমনব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে।
এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে এমন এক সময়ে যখন জনগণের পক্ষ থেকে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে থাকা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, এমনকি সংবিধানের আমূল সংস্কারের দাবি জোরদার হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এ জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা পুনর্প্রতিষ্ঠা এবং সাংবিধানিক সংস্কারের বিষয়গুলো উঠে এসেছে, যার লক্ষ্যই হলো সংবিধানকে জনগণের অভিপ্রায় পূরণের সহযোগী এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকারী একটি দলিলে পরিণত করা।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র এখন আর জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে সহায়ক নয়। জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ জনগণের সব অংশের অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনেÑ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেরÑ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার বাস্তবায়নের উপযোগী সংবিধান রচনা করা এখন জাতির রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তার প্রাথমিক আদর্শ এবং জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিল রেখে রচিত হয়েছিল। কিন্তু গত ৫৪ বছরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও দলীয় স্বার্থের কারণে প্রায়শই তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গেছে। বর্তমান সংবিধান জনগণের অধিকার এবং গণতন্ত্রের মানদ- নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। তাই দেশের স্থায়ী ও গণতান্ত্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, জনগণের মালিকানা এবং মৌলিক মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যÑ নাগরিক, রাজনৈতিক সমাজ ও বিচারব্যবস্থার সবাইকে একত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক

