ঢাকা বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫

ঋণ পরিশোধে জটিলতা, চাপে আদানি-পিডিবি

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২৫, ০৬:১৭ এএম
ঋণ পরিশোধে জটিলতা, চাপে আদানি-পিডিবি। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডের (এপিএল) বিদ্যুৎ বিলের ৯০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার বকেয়া চেয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে চিঠি দিয়েছে। আদানির দাবি, বকেয়া না পাওয়ায় তারা তাদের ঋণদাতাদের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। এতে ঋণদাতাদের কাছে তাদের চরম সমস্যা ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমনকি ঋণদাতা সংস্থাগুলো আদানিকে মূলধন সহায়তা প্রত্যাহারের হুমকি দিচ্ছে বলেও দাবি করা হয়েছে।

আদানি এনার্জি সলিউশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিল সারদান স্বাক্ষরিত চিঠিটি সরাসরি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে লেখা হয়েছে। এর একটি করে অনুলিপি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান ও সচিবকেও দেওয়া হয়েছে। যার একটি অনুলিপি রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে।

চিঠিতে আদানি গ্রুপ দাবি করেছে, এপিএল ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সরবরাহ শুরু হওয়ার পর থেকে দীর্ঘমেয়াদি পাওয়ার ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) অনুসরণ করে আসছে। তাই ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় অবস্থিত তার ডেডিকেটেড আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার প্রকল্প (গোড্ডা টিপিপি) থেকে বিপিডিবিকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে। যা আদানি পাওয়ার উত্তর বাংলাদেশে সরবরাহ করা বিদ্যুতের একটি প্রধান উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

আদানির দাবি অনুযায়ী, এপিএল বিপিডিবিকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে এবং বিনিময়ে বিপিডিবিকে পিপিএর বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিশাল বকেয়া পরিশোধের জন্য অনুরোধ করে আসছিল। যার পরিমাণ চলতি বছরের ২০ মে পর্যন্ত ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

চিঠিতে বলা হয়েছে, বিপিডিবি থেকে বিলম্বিত এবং অপর্যাপ্ত অর্থপ্রদান এপিএলের আর্থিক অবস্থাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে এবং ঋণদাতাদের ঋণ পরিশোধে ব্যাপক সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তা ছাড়া জ্বালানি ও খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহের জন্য প্রচুর এবং ব্যয়বহুল ঋণের মাধ্যমে কার্যকরী মূলধন পরিস্থিতি পরিচালনা করা হচ্ছে। বিপিডিবির ক্রমাগত পরিশোধে খেলাপি হওয়ার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এপিএলের মূলধন সহায়তা প্রত্যাহারের হুমকি দিচ্ছে।

আদানির ভাষ্য অনুযায়ী, বিপিডিবি নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রায় ৯০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিয়মিত মাসিক বিল পরিশোধের ব্যবস্থা করছে। কিন্তু এই সংকটের মুহূর্তে, অর্থ উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের চেয়েছে আদানি গ্রুপ। যাতে নিয়মিত বিলের পাশাপাশি বকেয়া পরিশোধ করা হয়। এই বিশেষ হস্তক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশের কৃষি ব্যাংক অথবা অন্য কোনো নিযুক্ত ব্যাংককে যথাযথ আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া হয় যাতে এপিএলএর বকেয়া পাওনা দ্রুত পরিশোধ করা যায়। আর আদানিও বাংলাদেশে তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং নির্ভরযোগ্য পরিষেবা নিশ্চিত করে যাবে।

জানা গেছে, আদানি দাবি করছে ৯০০ মিলিয়ন ডলার আর বাংলাদেশ বলছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার। এই সমস্যার মধ্যেই নতুন করে শুরু হয়েছে অর্থ পরিশোধের জটিলতা। বিদ্যুৎ বিভাগ আদানির বকেয়া পরিশোধের জন্য অর্থ বিভাগের কাছে টাকা চাইলেও অর্থ বিভাগ তা দিতে অস্বীকার করেছে। অর্থ বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সব পাওনাদারদের বকেয়া একটি পরিকল্পনা অনুসারে পরিশোধ করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনায় আদানিও রয়েছে।

সূত্র জানায়, আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার পর প্রথম সাত মাস আওয়ামী লীগ সরকার ডলার সংকটের জন্য কোনো বিল পরিশোধ করেনি। এ জন্য আদানিকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ডলার সংকট চলছে তাই আপাতত বিল পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। এই বিল জুলাইর পর পরিশোধ করা হবে। কিন্তু সরকার জুলাইর পর নিয়মিত বিল পরিশোধ করলেও বকেয়া পরিশোধ করতে পারেনি।

যা ১৫ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি সুদে ৭০০ মিলিয়ন ডলার হয়। তবে আদানি দাবি করছে ৯০০ মিলিয়ন ডলার। এদিকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আদানির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই চক্রবৃদ্ধি সুদকে সরল সুদে রূপান্তর করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকার যদি আদানির ডলার পরিশোধ করতে না পারে তাহলে এই সুদ প্রতিদিনই বাড়তে থাকবে। তাই জরুরিভিত্তিতে ডলার পরিশোধ করা দরকার। এ জন্য অর্থ বিভাগের কাছে ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থ চাওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থ বিভাগের সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়েছে। যা আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। এখনো এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আদানির বিদ্যুৎ কেনার বিষয়ে অর্থ বিভাগ কিছুই জানে না। এমনকি চুক্তির বিষয়েও তাদের কিছু জানানো হয়নি। ফলে এই বিষয়ে অর্থ বিভাগের কোনো আগ্রহ নেই। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে তাদের কাছে ঋণ পরিশোধ বিষয়ে যোগাযোগ করেছে। বিদ্যুৎ উপদেষ্টা অর্থ সচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন।

এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছেন, যেহেতু আদানির বিদ্যুৎ কেনা বা চুক্তির বিষয়ে অর্থ বিভাগ কিছু জানে না, তাই এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের আপাতত কিছু করা নেই। তা ছাড়া বাজেটেও এ-সংক্রান্ত কোনো বরাদ্দ নেই।

জানা গেছে, মে মাসের ২২ তারিখ ঋণের অর্থ বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সফর করেছেন আদানি পাওয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এসবি খাইলিয়া। এ সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তাদের ঝাড়খণ্ডে কোম্পানির ১,৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ করা বিদ্যুৎ বিল অবিলম্বে নিষ্পত্তি করতে।

বাংলাদেশ সচিবালয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজের সাথে সাক্ষাতের সময়, সিইও ব্যাংক ঋণের ক্রমবর্ধমান দায়বদ্ধতার কথা উল্লেখ করে জরুরি ভিত্তিতে পরিশোধের জন্য চাপ দেন। তার সাঙ্গে ছিলেন আদানি পাওয়ারের প্রেসিডেন্ট (বাণিজ্যিক) এম.আর. কৃষ্ণ রাও।

সূত্র মতে, খাইলিয়া সাত মাসের বকেয়া পরিশোধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যা আদানি কর্মকর্তারা প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার বলে উল্লেখ করেছেন। বিপরীতে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এই অর্থের পরিমাণ ৭০০ মিলিয়ন ডলারের কম বলে মনে করে।

জানা গেছে, বৈঠকে খাইলিয়া বলেছেন, চলতি জুন মাসের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করলে ৫০ মিলিয়ন ডলার বিলম্বিত পেমেন্ট সারচার্জ মওকুফ করার হবে। যা তারা জানুয়ারিতে দেওয়া একটি মুলতবি প্রস্তাবও উত্থাপন করেছিলেন। প্রস্তাবে বিপিডিবির সাড়া না পাওয়ায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেছেন।

বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, সমস্যাটি সমাধানের জন্য শিগগিরই আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে। ২১ তারিখ আদানি প্রতিনিধিদল বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য বিপিডিবি চেয়ারম্যানের সাথেও দেখা করেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার আদানির বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট প্রায় ১৫ টাকায় কিনছে। এই দাম নির্ধারণের সময় কোনো আলোচনা হয়নি। তাদের দেওয়া প্রস্তাবই সরকার মেনে নিয়েছে। আলোচনাটি হয়েছিল নিয়ম রক্ষার জন্য। আদানির সরবরাহ করা বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশকে প্রতিমাসে ৬০ থেকে ৭০ মিলিয়ন ডলার বিল পরিশোধ করতে হয়। তবে সরকার বকেয়ার পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য প্রতিমাসে ১০০ মিলিয়ন বিল পরিশোধ করছে। কারণ সরকার এই বিষয়ে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না।

একটি সরকারি পর্যালোচনা কমিটি বলছে, আদানির কয়লার মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি বিদ্যুতের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া, আদানি প্রতি মাসে বিলম্বে পরিশোধের জন্য ২ শতাংশ ফি নির্ধারণ করেছে, যা বার্ষিক গড়ে ২৭ শতাংশে পৌঁছায়। ২০১৭ সালের এপ্রিলে হওয়া চুক্তির আওতায় আদানি ইতোমধ্যে পিডিবির কাছ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার বিলম্ব ফি আদায় করেছে।

জানা গেছে, কয়লা বিষয়ে বিশ্বখ্যাত একপার্ট টম ওয়েস্টকে আদানির সঙ্গে চুক্তির জন্য বাংলাদেশের পক্ষে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়ের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী তা আমলে নেয়নি। উল্টো আদানি তাকে নিয়োগ দিয়ে দেয় তাদের জন্য পক্ষে।

১,৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার গোড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী দামে পেতে পিডিবিকে আদানির সঙ্গে কয়লার মূল্য কমানোর বিষয়ে আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছে সরকারি পর্যালোচনা কমিটি।

২০২৩ সালে আদানি বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছিল যে, তাদের বিদ্যুতের দাম অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় কম হবে। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ ছিল ১১.৮৩ টাকা, যেখানে আদানি বিদ্যুতের মূল্য ছিল ১৪.৮৭ টাকা।

পিডিবি দাবি করেছে, আদানি চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত নিয়ম মেনে কয়লার দাম নির্ধারণ করছে না। চুক্তিতে বলা হয়েছে, কয়লার মূল্য নির্ধারণে দুটি সূচক অস্ট্রেলিয়ান নিউক্যাসল এবং ইন্দোনেশিয়ান কয়লা সূচক (আইসিআই) ব্যবহার করতে হবে।

আরেকটি বিতর্কের বিষয় হলো কয়লার দামে ছাড়। ২০২৩ সালে আদানি এই ছাড় প্রয়োগ করলেও ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে তা বন্ধ করে দেয়।

আদানির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের পাওনা পরিশোধের পরিবর্তে পিডিবি ছাড় দাবি করছে। প্রথমে তারা বকেয়া পরিশোধ করুক, তারপর আমরা ছাড় নিয়ে আলোচনা করতে পারি।’