অনেক বাধা আর বিপত্তির পর দীর্ঘ চেষ্টায় দখলমুক্ত হয়েছিল রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ট্রাকস্ট্যান্ডের মেয়র আনিসুল হক সড়ক। তবে আবারও আগের মতোই বেদখল হয়েছে সাতরাস্তা এলাকার এ সড়ক। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা সড়কজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রাক ও পিকআপ।
ফলে যে উদ্দেশ্যে এলাকাটি দখলমুক্ত করে যান চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, তা ব্যাহত হচ্ছে প্রতিদিনই। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বলছে, ওই এলাকায় শুধু পার্কিংয়ের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করবেন তারা। ভবন নির্মিত হলে দখলমুক্ত হবে তেজগাঁও সড়ক।
২০১৫ সালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ট্রাকের অবৈধ দখলমুক্ত করতে গিয়ে তখনকার প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ট্রাকচালক ও শ্রমিকদের রোষানলের মুখে পড়েন। চালক ও শ্রমিকরা বেশ কয়েক ঘণ্টা তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। সে সময় ট্রাকস্ট্যান্ডটি দখলমুক্ত হলেও কিছুদিন পর পর সেটি আবার দখল হয়ে যায়। প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন দফায় দফায় বেশ কয়েকবার এটির বেদখল রোধ করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেটি আর সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ৫ তারিখের পর এটার দেখভালে আছেন বিএনপির লোকজন। যদিও জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের সুপারিশেও এখানে বেশ কিছু ট্রাক রাখা হচ্ছে।
তবে সব কিছু দেখভাল করছেন কেন্দ্রীয় যুবদল, শ্রমিকদল ও তেজগাঁ থানা বিএনপির অঙ্গসংগঠনের লোকজন। এখান থেকে প্রতিদিন যে চাঁদা ওঠে তা মূলত থানা শ্রমিকদল, যুবদল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারায় দায়িত্ব পালন করেন।
সূত্র মতে, বর্তমানে এখানে প্রতিদিন প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজারের মতো ট্রাক থাকে। এসব ট্রাক থেকে ঘণ্টায় বা দিনের হিসেবে ভাড়া নেওয়া হয়। ফলে দিনব্যাপী সড়কটি প্রায় বন্ধ থাকে। অন্যদিকে ট্রাকের কারণে চলাচলরত মানুষ ও যানবাহনের চালকদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, চার লেনের সড়কের দুটি লেনই দখল করে আছে ট্রাক, পিকআপ আর কাভার্ড ভ্যান। দেখে গ্যারেজ মনে হলেও এটি মেয়র আনিসুল হক সড়ক। শুধু সড়ক দখলে রেখে অবৈধ পার্কিংই নয়, কোথাও কোথাও চলছে গাড়ি মেরামতের কাজও। কোথাও আবার ফুটপাতের ওপরেই উঠে গেছে ট্রাক।
মূল সড়কেরই যদি এ দশা হয়, তবে গলিগুলোর কী দশা তা সহজেই অনুমেয়। সার্ভিস লেনে রিকশা বা ভ্যান চলার পথ বন্ধ করে রাখা হচ্ছে গাড়ি। ফলে এ রাস্তা ধরে চলাচল করা যাত্রী ও পথচারীদের দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। তারা বলেন, ট্রাক-লরি রেখে অর্ধেক রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ মানুষের।
একাধিক পথচারীরা জানান, বছর দশেক আগে কয়েক দফা চেষ্টার পর ২০১৫ সালে তেজগাঁওয়ের সড়কগুলো দখলমুক্ত করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পরবর্তী সময়ে তৈরি হয় চার লেনের সড়ক। কিন্তু প্রায় আড়াই বছর স্বাভাবিক থাকলেও ফের দখলের কবলে চলে যায় তেজগাঁওয়ের সবগুলো সড়ক। এসব কারণে সাধারণ মানুষের কোনো স্বস্তি নেই। যে দল ক্ষমতায় আসে সে আগে নিজের আখের গোছাতে থাকে।
তবে চালকদের দাবি, নির্দিষ্ট পার্কিংয়ের অভাবেই তারা মূল সড়কে গাড়ি রাখতে বাধ্য হন। তারা বলেন, ট্রাক স্টেশন ভর্তি হয়ে যাওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে রাস্তায় গাড়ি রাখতে হয়। একই রকম কথা বলছে পুলিশ এবং পরিবহন মালিকরাও। তারা জানান, জায়গা সংকটের কারণেই এ অবস্থা।
শ্রমিকদের দাবি, গাড়ির তুলনায় পার্কিংয়ের জায়গা কম থাকায় রাস্তা দখলে নিয়েছে তারা। তারা বলছে, আমাদের যে টার্মিনালের দরকার তা এখনো হচ্ছে না। আমরাও চাই দ্রুত টার্মিনালটি হোক। আমাদের বলা হয়েছিল, ৩ তলা টার্মিনাল করে দেবে সিটি করপোরেশন। সেটি করে দিলেই আমরা আর রাস্তায় গাড়ি রাখবো না।
তবে শ্রমিকরা সড়কটি দখলে রেখেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তারা বলেছেন, এখনও দখলমুক্ত হয়নি তেজগাঁওয়ের মেয়র আনিসুল হক সড়ক। অভিযোগ রয়েছে, উত্তর সিটি করপোরেশনের ঢিলেমি ও দায়িত্ব অবহেলার কারণে ট্রাকচালক ও শ্রমিকরা রাস্তাটি দখলে নিয়ে টার্মিনাল বানিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তায় ট্রাক রাখার পাশাপাশি ফুটপাত দখল করেও গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য দোকানপাট। দিনে কিছুটা কম হলেও সন্ধ্যার পর সড়কটিতে বাড়তে থাকে ট্রাকের সংখ্যা। একপর্যায়ে ট্রাকের সারি চলে আসে সাতরাস্তা মোড় থেকে মূল সড়কে।
এ ছাড়া অন্যদিকে কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন পয়েন্ট পর্যন্ত থাকে এসব ট্রাক। পাশাপাশি ভূমি ও জরিপ অধিদপ্তরের সামনের সড়কজুড়েও রাখা হয় শত শত ট্রাক। বলা যায়, গোটা এলাকাই দখলে নিয়েছে ট্রাকচালক শ্রমিকরা। একটি যানবাহন কোনোমতে যেতে পারলেও দুইটি একসঙ্গে গেলেই সৃষ্টি হয় ব্যাপক যানজট।
এ ছাড়া ট্রাকের আড়ালে ও ফুটপাত দখলের কারণে রাতে ছিনতাইকারী এবং মাদকসেবীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এলাকাটি। ফলে প্রতিনিয়ত যানজটের বিড়ম্বনার পাশাপাশি নিরাপত্তাঝুঁঁকি নিয়েও চলতে হয় যাত্রী-পথচারীদের।
প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করেন জয়নাল। তিনি বলেন, রিকশার জন্য যে রাস্তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সেখান দিয়ে আসলে রিকশা চলতে পারে না। এক হিসেবে রাস্তা বন্ধই থাকে। ট্রাক-পিকআপ রাস্তাটা অকার্যকর করে রেখেছে। আগে শুনতাম আওয়ামী লীগের লোকেরা দখল করে ব্যবসা করছে। এখন তো আর আওয়ামী লীগ নেই তাহলে এ রাস্তা কাদের দখলে? নিশ্চয়ই বিএনপি বা অন্য কোনো দলের লোকজন এসব অপকর্মে জড়িত।
রিয়া আক্তার নামে আরেকজন অভিযোগ জানিয়ে বলেন, অনেক চেষ্টায় দখলমুক্ত হয়েছিল তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড। কিন্তু এটি আগের মতো শ্রমিকদের দখলে রয়েছে। পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করে। রহিমা বেগম নামে আরেকজন বলেন, ট্রাকের কারণে অধিকাংশ যানবাহন ও মানুষ এক লেন দিয়ে চলাচল করে। ফলে যানজট লেগেই থাকে।
এখানের রবিউল নামে স্থানীয় এক দোকানদার জানান, সড়কটি ৫ আগস্টের আগে কিছুটা দখলমুক্ত থাকলেও এরপর আবার শ্রমিকদের দখলে চলে গেছে। ট্রাকের কারণে অনেক সময় সাধারণ মানুষের চলাচলের ও উপযোগী থাকে না। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির (জাতীয়তাবাদীপন্থি) একজন যুগ্ম সাধারণ
সম্পাদক বলেন, আমরা চেষ্টা করছি রাস্তাটি ফাঁকা রাখার জন্য। কিন্তু এত ট্রাক ইচ্ছা করলেও সেটি সম্ভব হয় না। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির একাধিক নেতা জানান, স্থায়ী টার্মিনাল তৈরি না হলে এই সমস্যা সমাধান হবে না। তবে ৫ তারিখের পর এটি বিএনপি নেতাদের দখলে চলে গেছে, ফলে ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু করা সম্ভব না।
ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, আমাদের স্থায়ী টার্মিনাল তৈরি না হলে এই সমস্যা কোনোভাবে সমাধান সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমাদের ট্রাক শ্রমিকরা এখান থেকে কোথায় যাবে? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেজগাঁও বিভাগের পুলিশের দায়িত্বশীল অতিরিক্ত উপকমিশনার বলেন, যদিও এটা ট্রাফিক বিভাগ ও সিটি করপোরেশনের বিষয়।
তবে আমাদের এলাকার মধ্যে পড়ায় এসব নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময় আইনি নোটিশ পেয়ে থাকি এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এটি দখলমুক্ত করতে আমাদের কাছে সিটি করপোরেশন যদি আইনি পদক্ষেপের সহযোগিতা চায়, তাহলে তাদের সাহায্য করব। তবে এখানে রাজনৈতিক কিছু বিষয়ও রয়েছে। ৫ তারিখের পর এর নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় বিএনপির নেতাদের হাতে। তারা না চাইলে এটি দখল মুক্ত করা অসম্ভব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক-তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে আসা ট্রাকগুলোর জন্য তেজগাঁওয়ে যে জায়গা নির্ধারণ করা রয়েছে, সেটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই ছোট। যে কারণে অনেক ট্রাক রাস্তা দখল করে থাকে।
তবে এসব বিষয়ে স্থানীয়দের দাবি, যে উদ্দেশ্যে এই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল সেই উদ্দেশ্য যাতে সফল হয়, সে জন্য যা করা দরকার সেটিই করুক কর্তৃপক্ষ।
এ দিকে সমস্যার কথা স্বীকার করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, পার্কিংয়ের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতায় সেই কাজ থমকে আছে। তবে পার্কিংয়ের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করতে সময় প্রয়োজন। সিটি করপোরেশন জায়গা বুঝে পেলেই কাজ শুরু করবে।