জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আগে ও পরে দেশের অন্তত ১৭টি কারাগারে হামলা হয়। এর মধ্যে ৮টি কারাগার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় দুই হাজার দুইশ বন্দি কারাগার থেকে পালিয়ে যায়।
কঠিন এ পরিস্থিতিতে কারা অধিদপ্তরের হাল ধরেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন, এনডিসি, পিএসসি। গত বছরের ১১ আগস্ট কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি।
সেনাবাহিনীর এই চৌকষ কর্মকর্তা দায়িত্ব নেওয়ার পর কারাগারে অসন্তোষ থেকে শুরু করে অনেক কঠিন পরিস্থিতি দৃঢ়ভাবে সামাল দেন। পাশাপাশি কারাগারগুলোয় সংস্কারকাজ শুরু করেন। এ ছাড়া কারাগারের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।
গত এক বছরে কারাগার সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রূপালী বাংলাদেশের সিনিয়র রিপোর্টার শহিদুল ইসলাম রাজী।
রূপালী বাংলাদেশ: গণঅভ্যুত্থানের পরপরই কারা অধিদপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছেন। গত এক বছরে কারাগারকে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে কি কি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন?
কারা মহাপরিদর্শক: বাংলাদেশ কারা অধিদপ্তরের সবচেয়ে বড় সমস্যা, এ অধিদপ্তর যে আইন অথবা বিধিবিধানগুলো নিয়ে চলছে, সেগুলো অনেক পুরোনো। যদি আমাদের জেল কোডের কথা বলি, এটা ১৮৬৪ সালের। প্রিজন্স অ্যাক্ট-১৮৯৪ এবং প্রিজনার্স অ্যাক্ট-১৯০০ সালের।
এ তিন আইন দ্বারা কারাগার পরিচালিত হচ্ছে। যদিও সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন কারণে কিছু ছোট ছোট পরিবর্তন হয়েছে; তবে মূল বিষয় আগের আইনেই রয়ে গেছে। ফলে কারাগারের আধুনিকায়নের মূল প্রতিবন্ধকতা পুরোনো আইন।
এরই মধ্যে নতুন করে ‘বাংলাদেশ প্রিজন অ্যান্ড কারেকশন সার্ভিস অ্যাক্ট-২০২৫’ খসড়া তৈরি হয়েছে। এটা সরকারের কাছে আমরা উপস্থাপন করব। আমরা আশা করছি, সরকার যদি যাচাই-বাছাই করে এটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন দেয় তাহলে কারাগারের মূল সমস্যা দূর হবে।
একটা সময় প্রচলন ছিল বন্দিদের শাসন বা অত্যাচার করে সংশোধন করা। তবে সেই ধারণারও পরিবর্তন হয়েছে। এ জন্য সংশোধনমূলক কার্যক্রম গতিশীল করতে চাই। কারাগারের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যেও এ কথা বলা হয়েছে ‘রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ।’ বাংলাদেশ কারাগারের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নতুন নাম হবে ‘কারেকশন সার্ভিস বাংলাদেশ’।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারাগারগুলোয় বন্দিদের সংশোধনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিশীলিত মানুষ হিসেবে সমাজে উপস্থাপন করতে চাই। যাতে একজন বন্দি কারাগার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়ে পরিবার তথা সমাজকে সাহায্য করতে পারে। খসড়া আইন চূড়ান্ত হলে অদূর ভবিষ্যতে কারাগারে বড় পরিবর্তন হবে বলে আশাবাদী।
এ ছাড়া সব কারাগারের কার্যক্রম স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক হিসেবে গড়তে বর্তমান প্রশাসন বন্দি ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ নিয়েছে। কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় পদায়ন করা হয়েছে। এটাও একটা বড় সংস্কার বলে মনে করি।
রূপালী বাংলাদেশ: দেশের কারাগারগুলোয় ধারণক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত বন্দির বিষয়টি বেশ আলোচিত। এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাই।
কারা মহাপরিদর্শক: কারাগারগুলোয় ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বন্দি থাকে। এটা দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের একই চিত্র। দেশের কারাগারে ৪২ হাজারের মতো বন্দি ধারণক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে আছে ৭৫ হাজারের বেশি। যে কারণে বন্দি ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
এ সমস্যা সমাধানে সরকার এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। পাঁচটি পুরোনো কারাগার নতুন করে তৈরির প্রকল্প চলমান। এ ছাড়া আরও ১৭টি পুরোনো কারাগারের সংস্কারকাজ চলছে। এই কাজগুলো হলে কারাগারে ধারণক্ষমতা বাড়বে। সমস্যারও সমাধান হবে আশা করি।
রূপালী বাংলাদেশ: বন্দিদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে কি ধরনের ব্যবস্থা আছে। গড়ে কতজন চিকিৎসক রয়েছেন কারাগারগুলোয়?
কারা মহাপরিদর্শক: এটা আমাদের একটা বড় সমস্যা। প্রতিটি কারাগারে হাসপাতাল ও নিয়োগকৃত ডাক্তার আছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই ডাক্তারদের আমরা পাই না। এ জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর। ডাক্তারের ১৪১ পদ থাকলেও ডেপুটেশনে মাত্র দুইজন পেয়েছি।
এ ছাড়াও ১০৩ জন ডাক্তার আছেন যারা অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন জায়গায় সিভিল সার্জন অফিস থেকে এসে আমাদের সহায়তা দিয়ে থাকেন। যেহেতু ডেডিকেটেড ডাক্তার নেই, ফলে তাদের সেবাও আমরা পাই না। ফলে আমরা বন্দিদের পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পারছি না।
এ ছাড়া আমাদের কেন্দ্রীয় কোনো হাসপাতালও নেই। যে কারণে চিকিৎসার জন্য সারা দেশ থেকে আসা বন্দিদের ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠাতে হয়। এ সমস্যা সমাধানে কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল হলে বন্দিদের চিকিৎসার সমস্যার সমাধান হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: গত বছরের ৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৮৮ জনসহ অন্তত ২ হাজার ২৪১ জন বন্দি পালিয়েছেন। সাজাপ্রাপ্ত এসব আসামির একটি বড় অংশ এখনো পলাতক। এখন পর্যন্ত কতজন পলাতক রয়েছে?
কারা মহাপরিদর্শক: প্রায় ২ হাজার দুই শতাধিক বন্দি পালিয়েছে সত্য। এসব বন্দির কেউ আত্মসমর্পণ করেছেন, কেউ জামিনে মুক্ত হয়েছেন আবার অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। সব মিলিয়ে এখনো সাত শতাধিক বন্দি পলাতক রয়েছেন। যারা এখনো পালাতক, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৮৮ জনের মধ্যে ৬৯ জন পলাতক, বাকিরা ধরা পড়েছে।
রূপালী প্রতিবেদক: অভ্যুত্থান পরবর্তী কারাগারের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। দেখা যায়, অনেক কারাগারের সীমানা প্রাচীর ছোট। এসব বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাই।
কারা মহাপরিদর্শক: গত ৫ আগস্ট ঘিরে কারাগারে যে ঘটনা ঘটেছে, প্রতিটির জন্য আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলাম। কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে। যদিও ঘটনাগুলো গণঅভ্যুত্থান কেন্দ্র করেই হয়েছে। উপমহাদেশের কারা ইতিহাসে এমন ঘটনার নজির নেই।
আমাদের ফোকাস ছিল প্রতিটি ঘটনার দুর্বলতা খুঁজে বের করা। সব ঘটনা কিন্তু একই রকম নয়। কোথাও বাইরের মব এসে ভেঙেছে, কোথাও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি বলে বন্দিরা পালিয়েছে। এ ছাড়াও কিছু ঘটনা কারারক্ষীদের অব্যবস্থাপনা এবং দায়িত্বে অবহেলার জন্যও ঘটেছে।
প্রতিটা ঘটনা ভিন্নভাবে পর্যালোচনা করে বেশকিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করেছি। কারাগারে মূল দুর্বলতা কাঠামোগত সমস্যা। এরমধ্যে যেগুলো তাৎক্ষণিক সংশোধন সম্ভব সেগুলো করেছি। যেগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ, সেগুলো পরবর্তীতে যে স্থাপনাগুলো নির্মিত হবে সেগুলোয় এ কারেকশনগুলো অলরেডি দিয়েছি। সুতরাং কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো পরিকল্পনা এবং নির্মাণের ক্ষেত্রে সংস্কারের চেষ্টা করছি।
রূপালী বাংলাদেশ: কারাগারে বন্দিদের মাদক ও মোবাইল ব্যবহার নিয়ে আলোচনা আছে। এ ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কী?
কারা মহাপরিদর্শক: কারাগারে মাদকের বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। একজন বন্দি কারাগারে আসার পর থেকেই তাকে নজরদারির আওতায় আনা হয়, যাতে মাদক নিয়ে কেউ কারাগারে ঢুকতে না পারে।
মাদক নিয়ে কোনো কারারক্ষী অথবা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থ নেওয়া হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে মাদকের সংশ্লিষ্টতা আছে, তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
এক্ষেত্রে সংখ্যাটাও নেহায়েত কম না। কারারক্ষী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ যদি মাদক নিয়ে ধরা পড়ে তাদের আমরা পুলিশে দিচ্ছি। কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
এ ছাড়া কারাগারে অবৈধ মোবাইলের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে তল্লাশি হয়ে থাকে। এন্ট্রিতেও কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারাগারের বাইরে থেকে মোবাইল ছুড়ে দেওয়া হয়। এ সংখ্যাটা অত বেশি না। তবে আমাদের অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমেই মোবাইল কারাগারে ঢোকে।
এক্ষেত্রে বন্দিদের এন্ট্রি কঠোর নজরদারিতে নিয়ে এসেছি। অবৈধ মোবাইল উদ্ধারে শুধু কেরানীগঞ্জ কারাগারে রাতের বেলায় গত ৯ মাসে প্রায় ১ হাজারেরও বেশি তল্লাশি করেছি। কেরানীগঞ্জ কারাগারে মোবাইল ব্যবহার একদম শূন্যে নামিয়ে আনতে না পারলেও সংখ্যাটা অনেক কমে গেছে।
এটা ম্যানুয়ালি জিরো করা সম্ভবও নয়। এক্ষেত্রে আমরা প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছি। কিছু কিছু স্পর্শকাতর জায়গায় আমরা মোবাইল নেটওয়ার্ক জ্যামার স্থাপন করেছি। শুধু তাই নয়, সব কারাগারে নেটওয়ার্ক জ্যামার বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রূপালী বাংলাদেশ: কারা বন্দিদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী খাবার নিয়েও অভিযোগ রয়েছে।
কারা মহাপরিদর্শক: করাগারে বন্দিদের খাবারের বিষয়টি অনেক পুরোনো অভিযোগ। বন্দিদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী খাবারসহ অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিতে জেল সুপার এবং ডিআইজিদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। গত এক বছরে বন্দিদের উন্নত খাবার পরিবেশনে আন্তরিকতার কমতি নেই।
এ ক্ষেত্রে আমরা অনেক উন্নতিও করেছি। এখন কেউ খাবারের পরিমাণ নিয়ে আগের মতো অভিযোগ দিতে পারবে না। হয়তো স্বাদ নিয়ে অভিযোগ থাকতে পারে, সেটাও কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
রূপালী বাংলাদেশ: দেশের কারাগার ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
কারা মহাপরিদর্শক: ৬৮টি কারাগার থেকে এখন আমাদের আরও ৫টি কারাগার বাড়ছে। এজন্য ১ হাজার ৮৯৯ জন জনশক্তি বেড়েছে। ফেনী, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, মাগুরা ও পিরোজপুরের সাধারণত পুরোনো কারাগারগুলোকে নতুন করে চালু করা হচ্ছে। বন্দি ব্যবস্থাপনায় টেলিফোনিং ব্যবস্থা অটোমেটিক সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসছি। এই প্রকল্প এরইমধ্যে শুরু হয়েছে। ধাপে ধাপে কয়েকটি কারাগারে চালু হয়েছে।
কারণ সিস্টেমই কন্ট্রোল করবে তাদের কথা বলার সময়, টাকা-পয়সা খরচ। সে যদি কুরুচিপূর্ণ কোনো কথা অথবা মানসিকভাবে ক্ষতিকর কোনো শব্দ ব্যবহার করে তাহলে এআই সফটওয়্যার দিয়ে ওয়ার্নিং জেনারেট করবে। এক্ষেত্রে বন্দিদের তিনটা নম্বরে কল করার সুযোগ থাকবে।
সেক্ষেত্রে বন্দিদের একটা পিন নম্বর দেওয়া হবে। ‘ওয়ান’ ডায়েল করলে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে পারবে। ‘টু’ ডায়েল করলে বন্দি তার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারবে। এ ছাড়া ‘থ্রি’ ডায়েল করলে তার সন্তান বা যাকে চায় তার সঙ্গে কথা বলতে পারবে। পুরো সিস্টেমটাই আমাদের মনিটরিংয়ের আওতায় থাকবে।
রূপালী বাংলাদেশ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কারা মহাপরিদর্শক: রূপালী বাংলাদেশ পরিবারকেও ধন্যবাদ।
আপনার মতামত লিখুন :