বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৫, ০১:৩১ এএম

ওষুধ কিনতে জীবন যায়

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৫, ০১:৩১ এএম

ওষুধ কিনতে জীবন যায়

নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বেড়েই চলেছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম। প্রতিদিনই কোনো না কোনো কোম্পানি ইচ্ছামতো বাড়াচ্ছে তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নির্ধারিত দামের তোয়াক্কা না করে দিনের পর দিন চলছে এই স্বেচ্ছাচারিতা। ঊর্ধ্বমুখি দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওষুধ কিনতে গিয়ে জেরবার হচ্ছে মানুষ। জীবন বাঁচাতে ওষুধ কিনতে গিয়ে উল্টো জীবন যাওয়ারই উপক্রম হয়েছে এখন মানুষের। 

বছরের শুরু থেকে গত ৭ মাসে দেশে ১০ থেকে ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে জরুরি ব্যবহার্য ওষুধের দাম। এতে জীবন বাঁচাতে নিত্যপণ্যে কাটছাঁট করে বাড়তি দাম দিয়েই ওষুধ কিনতে হচ্ছে রোগী ও তার স্বজনদের। এর জন্য ব্যবসায়ীরা ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দামকে দায়ি করেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এপিআই শিল্পপার্ককে কার্যকর করে ওষুধের কাঁচামাল এখানেই তৈরি করা সম্ভব। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অভিজ্ঞ ফার্মাসিস্টদের কাজে লাগিয়ে দেশের অভ্যন্তরেই কাঁচামাল তৈরি করা গেলে যেমন কাঁচামাল আমদানি করতে হবে না, তেমনি কোম্পানিগুলো ডলারের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যকে দায়ী করে প্রতিনিয়ত ওষুধের দাম বাড়াতে পারত না। এক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনকে আরও তৎপর হওয়ার তাগিদ তাদের। অন্যদিকে ওষুধ প্রশাসনের উদাসীনতাকে দায়ী করে দাম নির্ধারণে সরকারের স্বতন্ত্র ইউনিট করার দাবি জনস্বাস্থ্যবিদদের। 
দেশে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগে আক্রান্ত কয়েক কোটি মানুষ। এক গবেষণা মতে, একজন রোগীর গড় চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ ভাগই যায় ওষুধ কেনার পেছনে। ফলে, ওষুধ কিনতে গিয়েই প্রতি বছর দরিদ্র হন অনেক রোগী। এসব রোগীর কথা চিন্তা করে গত বছর তিন ভাগের এক ভাগ দামে ওষুধ বিক্রির উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ‘সরকারি ফার্মেসি’গুলোতে মিলবে ২৫০ ধরনের ওষুধ। তা দিয়েই ৮৫ ভাগ রোগীর চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু গত ৩১ বছরেও নির্ধারিত ১১৭টি ওষুধের দাম তালিকা পরিবর্তন করেনি কোনো সরকার। এসব ওষুধের বেশির ভাগেরই নেই ব্যবহার আর যেগুলো আছে সেগুলো পাওয়া যায় না কোনো ফার্মেসিতে। অন্যান্য ওষুধেরও মূল্য লাগামছাড়া। কয়েক মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১১০ শতাংশ পর্যন্ত। 

সম্প্রতি দেশজুড়ে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনাভাইরাসসহ ভাইরাল ফ্লু’ চলছে সারা দেশে। এমন পরিস্থিতিতে চাহিদা বেড়েছে জ¦রের চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধের। পাশাপাশি ঠান্ডাজনিত রোগে ব্যবহৃত ওষুধ ফেক্সো, ফেনাডিন, ডক্সিভার মতো ওষুধগুলোরও চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। এই সুযোগে কোম্পানিগুলো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই রোগীদের জিম্মি করে বাড়াচ্ছে দাম। 

এক পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্যারাসিটামল ৫০০ মিলিগ্রামের প্রতি পিস ওষুধের মূল্য ছিল ১.৫০ টাকা। যা চলতি মাসে অর্থাৎ আগস্টে বিক্রি হচ্ছে ২ টাকা ৫০ পয়সায়। ১ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৬৬.৬৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে ওষুধটির দাম। একইভাবে সালবিউটামল ইনসুলিন (১০ এমএল) ফেব্রুয়ারিতে ১২০ টাকায় বিক্রি হলেও মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে ৩৩.৩৩ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পেয়ে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা। এমঅক্সিসিলিন ৫০০ মিলিগ্রামের দাম ৬ টাকা থেকে ৬ মাসের মধ্যে দাম বেড়েছে ৯ টাকা। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ওমোপ্রাজল ২০ মিলিগ্রামের দাম ৩ টাকা থেকে বেড়ে প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৪ টাকা ৫০ পয়সা। এটির মূল্য বেড়েছে ৫০ শতাংশ হারে। শুধু তাই নয়, কিটোরোলাক ট্রোমেটামল গ্রুপের ব্যথার ওষুধ টোরেক্স। এর ১০ এমজির ৫০টি ট্যাবলেটের এক প্যাকেটে গায়ের বিক্রয়মূল্য গত বছরের আগস্টেও ছিল ৬০০ টাকা। এতে প্রতি পিস ট্যাবলেটের দাম পড়ে ১২ টাকা। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রস্তুতকৃত অপর একটি প্যাকেটের গায়ে মূল্য ধরা হয় ১০০০ টাকা। যেখানে প্রতিটি ওষুধের মূল্য ধরা হয়েছে ২০ টাকা। মাত্র ১ মাসের ব্যবধানে ওষুধটির দাম বাড়ে ৬০ শতাংশ। 

সরেজমিনে ওষুধের বাজার ঘুরে দেখা যায়, সম্প্রতি জ্বর-সর্দির মৌসুমে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ফেক্সোফেনাডিন প্রতি পিস ৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪ টাকা। অ্যাজিথ্রোমাইসিন প্রতি পিস ৩৫ টাকা থেকে হয়েছে ৪০ টাকা। ভিটামিন বি১ বি৬ বি১২ এর প্রতি পিসের দাম ৭ টাকা থেকে দুই ধাপে দাম বেড়ে ১০ টাকা হয়েছে। গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইসমোপ্রাজলের প্রতি পিসের দাম ৫ টাকা থেকে ৭ টাকা হয়েছে। লোসারটান পটাশিয়াম ৫০ মিলিগ্রামের প্রতি পিসের দাম ১০ টাকা থেকে ১২ টাকা হয়েছে। প্যারাসিটামল ৫০০ মিলিগ্রামের ১০ পিস ওষুধের দাম ৮ টাকা থেকে ১২ টাকা হয়েছে। প্যারাসিটামল ৬৬৫ মিলিগ্রাম ১০ পিস ওষুধের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা হয়েছে। প্যারাসিটামল সিরাপের দাম হয়েছে ২০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা। অপারেশন পরবর্তী ট্যাবলেট টোরাক্স ১০ প্রতি বক্সে ৪০০ টাকার দাম বেড়ে হয়েছে এক হাজার টাকা। অথচ দেড় মাস আগেও দাম ছিল ৬০০ টাকা। কোলেস্টরেলের জন্য দেয়া হয় রসুভা ১০, যা প্রতি বক্সে বেড়েছে ৬০ টাকা। আর্থ্রাইটিসের ব্যথায় ব্যবহৃত ফ্লেক্সি ১০০, প্রতিবক্সে বেড়েছে ২০০ টাকা যা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেড় মাসের ব্যবধানে শুধু একটি ওষুধ কোম্পানির প্রায় ৩০টি আইটেমের দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওষুধের দাম কিছুটা বাড়লেও সবচেয়ে বেশি বেড়েছে স্কয়ার ফার্মার।  

বাজার ঘুরে আরও দেখা যায়, এক মাস আগেও ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কমেট ৫০০এমজির দাম ছিল ৫ টাকা পিস যা বর্তমানে দোকানভেদে ৭ থেকে ৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই রকমভাবে জিমেক্স ৩০ এমএল এর দাম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়, একই ওষুধের ৫০ এমএল ১৮৫ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়। এ্যানাডল এসআর নামের ক্যাপসুলটি ১০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৭ টাকা। ফাইলোপেন ফোর্ট সিরাপ ৯৮ টাকা থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কার্ডি কিউ.৫০ নামের ক্যাপসুলটি ১৪ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এলাট্রল সিরাপ ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রসুভা ১০ এমজি বিক্রি হচ্ছে ২২ টাকায়। ডার্মাসল এন অয়েন্টমেন্ট ৮০ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। এপিট্রা ০.৫ এমজি ৬ টাকা পিস থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮ টাকায়। ইকোস্প্রিন ছিল ৬ টাকা। 

ডলারের দাম বাড়ার কারণেই দামের ঊর্ধ্বগতি দাবি করে ওষুধ শিল্প মালিকদের সংগঠনের মহাসচিব ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘ওষুধের দাম এখনো বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কম। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দাম বাংলাদেশে। তবে দামের সঙ্গে গুণমান ও নিরাপত্তার সমন্বয় রাখতে হয়। মূল সমস্যা হলো, কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ বা ব্র্যান্ডের দামকে সব ওষুধের প্রতিচ্ছবি মনে করা হয়। সরকার দাম নির্ধারণ করে এবং প্রতিটি কোম্পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে। তবে উৎপাদন খরচ ও কাঁচামালের বৈশ্বিক দামের প্রভাব ওষুধের দামে পড়ে।

ভবিষ্যতে এপিআই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হলে কিছু ওষুধের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে’। তিনি আরও বলেন, ‘ওষুধের কাঁচামাল আমদানির জন্য আগে এলসি খুলতে লাগত ১ ডলারের বিপরীতে ৮০ টাকা। এখন যখন শিপমেন্ট এসে পৌঁছাচ্ছে তখন ডলারের দাম উঠেছে ১৩০ থেকে ১৩৮ টাকায়। প্রাইস পলিসি মোতাবেক প্রত্যেক বছরের বাজারের আর্থিক অবস্থা যাচাই করে এমআরপি পণ্যের দাম নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু ২০ বছরেও তা করা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দামও চড়া। এখন কিছু ওষুধের দাম না বাড়ালে প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা মুশকিল। আমরাও আসলে অসহায়’।

এদিকে দেড় দশকের বেশি সময়েও দেশে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির শিল্প দাঁড়াতে পারেনি। এ শিল্পের জন্য বরাদ্দ জমি এখনো প্রায় ফাঁকা। চাহিদার ৯৫ শতাংশ ওষুধ দেশে তৈরি হলেও এর কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। ১৭ বছর আগে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় এ শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য জমি বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার। সেখানে মাত্র ২ থেকে ৩টি প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল উৎপাদন শুরু করেছে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যেখানে ডলারের ঊর্ধ্বমুখি মূল্যের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে অজুহাতে ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে, সেখানে সকল সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এপিআইয়ে কেনো কোনো ব্যবসায়ী কাঁচামাল তৈরির কাজ শুরু করছে না, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা উচিত। প্রয়োজনের সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়ে হলেও কাঁচামাল দেশেই উৎপাদন করার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে কাঁচামাল আমদানির অজুহাতে দাম বাড়ার অজুহাত কমে যাবে। তবে এক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে বাজার তদারকিতে আরও সক্রিয় হতে হবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর যদি নিয়মিত বাজার তদারকি করে এবং কোনো কারণ ছাড়াই ওষুদের দাম বাড়ানো কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয় তাহলে আমি মনে করি দাম বাড়ানোর এ প্রবণতা কমে আসবে’। 

এ অবস্থা থেকে বের হতে সরকার কাজ করছে জানিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. শামীম হায়দার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘দেশীয় ব্যবস্থাপনায় ওষুধের কাঁচামাল তৈরি ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছে ডিজিডিএ। একইসঙ্গে এ খাত উন্নয়নে নীতি সহায়তার জন্য কমিটিও গঠন করা হচ্ছে। দেশে ওষুধের কাঁচামাল শিল্পের বিকাশ হোক এটা আমাদেরও চাওয়া। এই সেক্টরের বিকাশে আমাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। কাঁচামালের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে একসঙ্গে কাজ করব। তবে বাজার তদারকির জন্য যে জনবলের প্রয়োজন তার ঘাটতি আমাদের রয়েছে এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব’। 

চাহিদার ৯৫ শতাংশ ওষুধ দেশে তৈরি হলেও এর কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এই নির্ভরতা কমাতে এপিআই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করতে হবে। এতে উৎপাদন বাড়বে। ফলে দামও তুলনামূলক কমবে। 

এদিকে জরুরি ওষুধের বাড়তি মূল্যে নাভিশ^াস উঠেছে সাধারণ মানুষের। সংসারের খরচ কাটছাট করে ওষুধের বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে দাবি করে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা মিতু আক্তার বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবত আমি ডায়াবেটিসে ভুগছি। সঙ্গে আরও নানা রোগ ভর করেছে। নিয়মিত ওষুধ খেতেই হয়। কিন্তু সম্প্রতি ওষুধের বাড়তি দাম মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজার খরচ কমিয়ে, সকালে একটা ডিম না খেয়ে বা সন্ধ্যার নাস্তায় শুধু চা-বিস্কুট খেয়ে এই বাড়তি দাম মেটাচ্ছি’। 

একইভাবে দুঃখের কথা জানালেন, রাজধানীর মগবাজারের চেয়ারম্যানগলির মুখে আজিজ ফার্মেসিতে শিশু সন্তান রিফাতের জন্য নাপা সিরাপ কিনতে আসা মাহফুজ উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘চাল, ডাল, তেল, সবজি সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। যেকোনো কিছুর দাম বাড়লে সেটা খাওয়া কমিয়ে দেই। তেলের দাম বাড়ার পর তেল কেনা কমিয়েছি। কিন্তু ওষুধের প্রয়োজনীয়তা কমাব কীভাবে? শিশুর যদি জ্বর হয় নাপা সিরাপ খাওয়াতেই হয়। এদিকে বাসায় বয়স্ক মা উচ্চ রক্তচাপের রোগী। নিয়মিত তাকে ওষুধ খেতে হয়। আগে এক পাতা ওষুধ ৮০ টাকায় কিনতাম। এখন সেটা ১শ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আয় একই থাকছে খরচ বেড়েই চলেছে। বাঁচতে গেলে ওষুধ তো কিনতেই হবে। এ খরচ আমি কীভাবে কমাব?’।

এই ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী বলেন, ‘আগে আমরা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এই সিরাপ কিনতাম ১৮ টাকায়। কাস্টমারদের কাছে বিক্রি করতাম ২০ টাকায়। কিন্তু আমাদেরই এখন কেনা পরছে ৩১ টাকা। যা আমরা ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি করছি। এখানে তো আমাদের করার কিছু নেই। আমরা মাত্র ১২ শতাংশ লাভ পাই। বাকিটা তো কোম্পানিগুলো নিয়ে যায়’। 

এ বিষয়ে সারা বছর কথা বলেও কোনো কাজ হয় না উল্লেখ করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ক্যাব) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ডায়াবেটিস, প্রেসার, ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে নিয়মিত ব্যবহৃত ওষুধের দাম মাসের শুরুতে থাকে এক রকম। মাসের শেষে হয় আরেক রকম। আমরা প্রতিনিয়ত এটি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে বলে আসছি। কিন্তু তারা কোনোভাবেই এটি আমলে নেয় না। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যে তাদের যোগসাজশ রয়েছে এটি স্পষ্ট। করোনার সময় আমরা দেখেছি কোনো কারণ ছাড়াই ব্যবসায়ীরা প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুণ হারে। যেটি ছিল ব্যবসায়ীদের স্বেচ্ছাচারিতা। ওষুধের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে তারা বেশির ভাগ সময় বলেন কাঁচামালের দাম বেড়েছে। কিন্তু এটি কি সারা বছরই বাড়তি থাকে? ডলারের দাম তো এখন স্থিতিশীল। তাহলে এখন এলসি খুলতে গিয়ে তাদের তো সমস্যা হওয়ার কথা না। এখন কেন ওষুধের দাম বাড়বে?’। তিনি আরও বলেন, ‘চাল-ডালের ব্যবসায়ীদের মতো ওষুধ ব্যবসায়ীরাও এখন নিয়ম করে ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু কারো কোনো মাথাব্যথা নেই এ ব্যাপারে’। 
এর জন্য বিগত সরকারের নীতিমালাকে দায়ী করলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মানসম্মত ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিতে সরকারের একটি নীতিমালা থাকা উচিত। কিন্তু বিগত দিনগুলোতে সেটি হয়নি। যার সুযোগ নিয়েছে কোম্পানিগুলো। সরকারের প্রধান লক্ষ্য একেবারে কম দামে অথবা বিনামূল্যে জনগণকে ওষুধ দেওয়া। ইতিমধ্যে সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে’। 

তিনি আর বলেন, ‘বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে হাজারের বেশি অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ বাজারে এসেছে। কিন্তু গত ৩২ বছরেও সরকার নিয়ন্ত্রিত অত্যাবশকীয় ওষুধের তালিকায় একটিও যুক্ত হয়নি। যার কারণে পুরো বাজার সরকার নয়, কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে ওষুধের পেছনে ব্যয় বাড়ছে। অথচ ডাক্তার ফি, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ও আইসিইউর বিল নিয়ে কথা উঠলেও ওষুধ নিয়ে আলোচনা নেই’।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!