নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) রেভিনিউ শেয়ারিং না দেওয়া, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডর (আইএসপি) লাইসেন্স নিয়ে অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন সেবা দিয়ে প্রশাসনিক জরিমানার আওতায় পড়া এবং পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন) লাইসেন্সধারী থাকাকালে দেড় কোটি বকেয়া করে বিতর্কিত হওয়া বাংলা ফোনকে দেওয়া হচ্ছে এনটিটিএন লাইসেন্স। এর মাঝে রেভিনিউ শেয়ারিং এবং জরিমানার অর্থ পরিশোধ করায় বাংলা ফোনকে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে বিটিআরসি। তবে এখনো খবর নেই পিএসটিএন লাইসেন্সকালীন বকেয়ার। তবুও প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে এনটিটিএন লাইসেন্স ইস্যু করতে সরকারের পূর্বানুমোদন চেয়ে দ্বিতীয় দফায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে চিঠি দিয়েছে বিটিআরসি। অপটিক্যাল ফাইবারের প্রয়োজনীয়তা এবং ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক থাকায় বাংলা ফোনকে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী।
২০১০ সালে এনটিটিএন গাইডলাইনের আলোকে লাইসেন্স প্রদান শুরু করে বিটিআরসি। এর আগে থেকেই এনটিটিএন ব্যবসা করছিল বাংলা ফোন। প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তা আমেরিকাপ্রবাসী ব্যবসায়ী আমজাদ খান। লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালুর পর ২০১১ সালের জুনে এনটিটিএন লাইসেন্স পেতে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করে বাংলা ফোন। লাইসেন্স না পেলেও, সে সময় বিটিআরসির এক বিতর্কিত ‘পারমিট’ নিয়ে ‘ওভার হেড ক্যাবল’ তথা ঝুলন্ত ক্যাবলের মাধ্যমে এনটিটিএন ব্যবসা করে আসছিল বাংলা ফোন। পরবর্তী সময়ে এনটিটিএন লাইসেন্স চেয়ে ২০১৬ সালে আদালতে গিয়েও বিফল হন তিনি। তবে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর লাইসেন্সের জন্য বিটিআরসিতে আবারও আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এতেও জটিলতা কাটছিল না প্রতিষ্ঠানটির। এলআইএমএসের মাধ্যমে পুনরায় আবেদন করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সব দলিল যথাযথভাবে না থাকায়, সেগুলো হালনাগাদ করতে হয় বাংলা ফোনকে।
গত মে মাসে কমিশনের এক সভায় বাংলা ফোনের অনুকূলে এনটিটিএন লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় বিটিআরসি। ২৫ মে বাংলা ফোনকে লাইসেন্স দেওয়ার পূর্বানুমোদন চেয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে চিঠি দেয় বিটিআরসির লাইসেন্সিং শাখা। তবে সে সময় বাংলা ফোনের ওপর বকেয়া এবং অপরিশোধিত প্রশাসনিক জরিমানা ছিল। সূত্র বলছে, এসব কারণে বাংলা ফোনের অনুকূলে এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়ার পূর্ব-অনুমোদন দেয়নি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। জাতীয় পর্যায়ের আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) লাইসেন্সধারী হয়েও বিটিআরসির বিশেষ এক পারমিটের কারণে এনটিটিএন ব্যবসা করছিল বাংলা ফোন। নিয়ম অনুযায়ী, ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বিটিআরসির সঙ্গে যে রেভিনিউ শেয়ার করার কথা, সেটি করছিল না বাংলা ফোন। এ বাবদ প্রতিষ্ঠানটির কাছে ১ কোটি ৬৭ লাখ ১৫ হাজার ৫৬১ টাকা পাওনা বিটিআরসির। ২৫ লাখ সাত হাজার ৩৪৮ টাকা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট যোগ করলে এই অর্থ দাঁড়ায় ২ কোটি ২৮ লাখ ৭৬ হাজার ৭০৩ টাকা। একই সঙ্গে, আইএসপি লাইসেন্সের আওতাবহির্ভূত অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন সেবা পরিচালনার জন্য বাংলা ফোনের ওপর ১০ লাখ টাকা প্রশাসনিক জরিমানাও ছিল। সম্প্রতি এসব বকেয়া ও জরিমানার অর্থ পরিশোধ করে বাংলা ফোন।
বাংলা ফোনের নামে পূর্বে পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন) লাইসেন্স ছিল এবং সেখানে বিটিআরসির ১ কোটি ৫৬ লাখ ২৬ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে, বিটিআরসির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেÑ এই অর্থ এখনো পরিশোধ করেনি বাংলাদেশ। এ অবস্থাতেই বাংলা ফোনকে লাইসেন্স দিতে সরকারের পূর্বানুমোদন চেয়ে দ্বিতীয় দফায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে চিঠি দিয়েছে বিটিআরসির লাইসেন্সিং শাখা। গত ২১ জুলাই লাইসেন্সিং শাখার মহাপরিচালক আশীষ কুমার কু-ু স্বাক্ষরিত এক চিঠি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) বরাবর প্রেরণ করা হয়। চিঠিতে জানানো হয় যে, রেভিনিউ শেয়ারিং ও ভ্যাট এবং প্রশাসনিক জরিমানার অর্থ পরিশোধ করেছে বাংলা ফোন। তবে এই চিঠিতে পিএসটিএন লাইসেন্সধারী হিসেবে বিটিআরসির পাওনা বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই। বাংলা ফোনের বিষয়ে জানতে মহাপরিচালক আশীষ কুমার কু-ুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাংলা ফোনের মতো একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে এনটিটিএন লাইসেন্স দিতে অতিউৎসাহী হয়ে কাজ করছে বিটিআরসির একটি মহল। উপরন্তু, বিটিআরসি যেখানে লাইসেন্সিং ব্যবস্থাকে সংস্কার করে ঢেলে সাজাচ্ছে, তখন একটি প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। লাইসেন্সিং ব্যবস্থার সংস্কারের পর যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে বাংলা ফোনকে লাইসেন্স দেওয়া যেতে পারত বলে যুক্তি তাদের। এ বিষয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, “বাংলা ফোনের বিষয়টি কিন্তু নতুন কোনো ‘কেস’ না; পুরোনো কেস। যে এনটিটিএনগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, তাদের আগেই বাংলা ফোন কাজ শুরু করে। ২০১০ সালে লাইসেন্স দেওয়ার আগ পর্যন্ত পারমিট নিয়ে তারা কাজ করছিল। ওনাদের অভিযোগ, তাদের রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। তবে খাতা-কলমে দেখেছি যে, তাদের ঘোরানো হচ্ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের অনেক ফাইবার দরকার, ৫ লাখ কিলোমিটারের বেশি। কিন্তু আছে মাত্র দেড় লাখ কিলোমিটারের কিছু বেশি। লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু এনটিটিএন নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু দেখলাম যে, বাংলা ফোনের প্রচুর ফাইবার রয়েছে। তাই তাদের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে।’ লাইসেন্সিং ব্যবস্থার চলমান সংস্কারের মাঝে কেন এমন সিদ্ধান্ত, এ প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘লাইসেন্সিং ব্যবস্থা সংস্কার হয়ে যে রূপ পাবে, সেই রূপেই বাংলা ফোনকে ‘রেগুলেট’ করা হবে। এনটিটিএন অপারেটর আর টাওয়ার কোম্পানিগুলো মিলে একটি লাইসেন্সিং ব্যবস্থায় আসবে। বাংলা ফোনও সেখানে চলে যাবে।’’
এ বিষয়ে বাংলা ফোনের উদ্যোক্তা আমজাদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি হোয়াটস অ্যাপে লিখিত প্রশ্ন পাঠাতে বলেন। লিখিত উত্তরে আমজাদ খান বলেন, ‘বিটিআরসি আমাদের এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ-সংক্রান্ত চিঠি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তবে লাইসেন্সটি এখনো আমাদের হস্তান্তর করা হয়নি। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে একটি ন্যায্য দাবি নিয়ে আইনি লড়াই এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর আশাবাদী যে, খুব দ্রুতই লাইসেন্স হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। লাইসেন্স কবে নাগাদ ইস্যু করা হবে, সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিশ্চিত খবর পাওয়া যাবে।’ বাজারে ছয়টি সরকারি ও বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটর রয়েছে। এদের ভিড়ে নিজেদের জন্য ব্যবসার সুযোগ কেমন দেখেনÑ এই প্রশ্নের জবাবে আমজাদ খান বলেন, ‘বিদ্যমান বাজারে আমাদের জন্য একটি বিশাল সুযোগ দেখতে পাচ্ছি। বাংলা ফোন ২০০৪ সাল থেকে রবি, টেলিটক, বিভিন্ন ব্যাংক এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন সেবা প্রদান করে আসছে। আমাদের এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং দেশব্যাপী বিস্তৃত ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক আমাদের একটি শক্তিশালী ভিত্তি দেবে।’
বাংলা ফোনের বকেয়া এবং জরিমানার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে কমপ্লায়েন্স না মানার যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এগুলো ছিল পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদী সরকারের সুবিধাভোগী কিছু প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির চক্রান্ত, যারা একচেটিয়া বাজার ধরে রাখতে চেয়েছিল। আমাদের বিরুদ্ধে লাইসেন্স ছাড়াই অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক ট্রান্সমিশন পরিচালনার যে অভিযোগ ছিল, তা মিথ্যা। বাংলা ফোনের পারমিটের অধীনে অপটিক্যাল ফাইবার লিজ দেওয়ার জন্য বিটিআরসি থেকে আমাদের অনুমতি ছিল। আমরা এই লিজের জন্য ৫ দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব প্রদান করেছি, যা অন্যান্য এনটিটিএন অপারেটরদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা সম্পূর্ণভাবে আইন মেনে এবং সর্বোচ্চ কমপ্লায়েন্স বজায় রেখে ব্যবসা পরিচালনা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ তবে পিএসটিএন লাইসেন্সধারী হিসেবে বিটিআরসির কাছে বকেয়া ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বাংলা ফোন পরিশোধ করেছে কি না, সে বিষয়ে লিখিত প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি আমজাদ খান।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন