- বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা
- খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্পের বরাদ্দ ৪৬০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা
- বীরের কণ্ঠে বীরগাঁথা প্রকল্পের বরাদ্দ ৪৯ কোটি ৫৭ লাখ ৫ হাজার টাকা
- প্রকল্পগুলোর ধীর অগ্রগতি, বাস্তবায়ন নিয়েও ছিল নানা প্রশ্ন
- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও হচ্ছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রচার
- প্রকল্পগুলোর যতটুকু কাজ হয়েছে তার অর্থ পরিশোধের সিদ্ধান্ত
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভিত্তি। কিন্তু যখনই তা দলীয়করণ হয়, তখন ইতিহাস বিকৃতির ঝুঁকি তৈরি হয়। সরকার যদি প্রকল্পগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে বিকল্পভাবে একটি সর্বদলীয় ঐকমত্যভিত্তিক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নেওয়া উচিতÑ ড. মেসবাহ কামাল, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে এক অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ। ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের ব্যাপক অভিযোগ ছিল। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল আলোচনা-সমালোচনা। ফলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দলীয়করণ, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে এমন কিছু প্রকল্প আর এগিয়ে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাই প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলো অসমাপ্ত রেখেই শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প অসমাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে তার অর্থও পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। কয়েকটি প্রকল্পের তথ্য এসেছে রূপালী বাংলাদেশের হাতে।
তথ্য অনুযায়ী, অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন প্রকল্প’, ‘খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যমান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উন্নয়ন এবং মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহের স্মৃতিস্তম্ভ ও জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্প‘ এবং ‘বীরের কণ্ঠে বীরগাথা প্রকল্প’। প্রতিটি প্রকল্পই ইতিহাস-চর্চা, প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বার্তা পৌঁছে দেওয়া এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ স্মরণে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার মনে করছে, এগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চালু হয়েছিল, তাই আর এগোনো হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অনেক বিশেষজ্ঞ ‘অবশ্যই সাহসী’ বলছেন। তবে তারা বলছেন, এ জাতীয় প্রকল্পে একদিকে দলীয়করণ রোধ করা জরুরি, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও বাঁচিয়ে রাখা অপরিহার্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে নতুন একটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ট্রাস্ট গড়ে তোলা দরকার, যেখানে রাজনৈতিক দলের প্রভাব থাকবে না। তবেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যথার্থভাবে সংরক্ষিত হবে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন প্রকল্প : এ প্রকল্প মূলত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং স্থানীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরার কর্মসূচি নিয়ে গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এটি একটি অন্যতম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্পের ব্যয় ও কার্যক্রম রাজনৈতিক প্রচারের অংশ হয়ে পড়েছিল। নতুন সরকার তাই প্রকল্পটিকে আর এগিয়ে না নিয়ে, এরই মধ্যে যে কাজ হয়েছে কেবল তার আর্থিক হিসাব মিটিয়ে সমাপ্ত ঘোষণা করছে, যা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে তারা মনে করছেন।
এ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিলÑ ২৭০টি নিবন্ধিত কমিটির সহায়তায় প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন শিক্ষাক্রমে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিষয় সংযোজন, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, সেমিনার, স্থানীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজন এবং গণসচেতনতামূলক প্রচার চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তৎকালীন আওয়ামী সরকার এটিকে রাষ্ট্রের ‘জাতীয় চেতনা বিকাশ কর্মসূচি’র অংশ হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে কয়েক ধাপে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে।
তবে এই উদ্যোগ শুরুর পর থেকেই সমালোচনা বাড়তে থাকে। অনেক গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, প্রকল্পের তহবিলের বড় অংশ ব্যয় হয়েছে প্রচারমূলক কার্যক্রমে, যা মূলত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়। প্রকল্পের অর্থায়নেও ব্যাপক অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিহীনতার অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে, স্থানীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে যে কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়েছে, তার অনেকটিতেই দলীয় প্রভাব সুস্পষ্ট ছিল বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিকল্পনা কমিশনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি কাগজে-কলমে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচারের জন্য হলেও বাস্তবে এটি অনেকটা দলীয় কর্মসূচিতে পরিণত হয়। নতুন সরকার তাই মনে করেছে, রাষ্ট্রীয় অর্থ দিয়ে এ ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবিত কর্মসূচি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। এজন্য এটি অসমাপ্ত রেখেই বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এরই মধ্যে যে কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তার অর্থ পরিশোধ করে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হচ্ছে।
প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশ্লিষ্ট আরএডিপি থেকে বরাদ্দ ছিল ২ কোটি ৯২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদিত এ প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা ছিল ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটি বাবস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছিল জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। তবে প্রকল্পের ভিত্তি বছর থেকে কখনোই প্রকল্প শুরু করার নজির নেই।
মুক্তিযোদ্ধা সমাধিস্থল ও জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্প : এই প্রকল্পের আওতায় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে সমাধিস্থল নির্মাণ এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসমূহ আধুনিকীকরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহে নতুন স্মৃতিস্তম্ভ ও জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। কাজের একটি অংশ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হলেও পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। পরিকল্পনা কমিশনের নথি অনুযায়ী, অসমাপ্ত অংশ আর চালু হবে না। তবে সম্পন্ন হওয়া অংশের বিল মেটানো হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষায় অন্যতম একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল ‘খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্প’। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সংরক্ষণযোগ্য ও জীবন্ত করে তোলা। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের স্মরণ, তাদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যেই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল।
প্রকল্পের আওতায় প্রথমত, দেশের বিভিন্ন স্থানে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিক্ষেত্রগুলো সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বিশেষ করে যারা রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাহিত আছেন, তাদের সমাধি পুনর্নির্মাণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ ছিল। সমাধিস্থলগুলোতে আধুনিক অবকাঠামো, পরিচ্ছন্নতা ও স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
জানা গেছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ২০ হাজার সমাধিস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪৬০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে ২০২১ সালের ৩০ জুন সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। পুরো অর্থই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আর প্রকল্পটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় গণপূর্ত অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করছিল।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে জাদুঘর ও পাঠাগার গড়ে তোলার প্রকল্পটি চলমান ছিল। যার মাধ্যমে সারা দেশে ৩৬০টি মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বীরের কণ্ঠে বীরগাঁথা প্রকল্প :
এটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ ও বীরত্বগাঁথা সংগ্রহ করে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি পরিকল্পনা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার, ভিডিও ডকুমেন্টারি এবং প্রকাশনা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। প্রকল্পের কিছু কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হলেও পূর্ণাঙ্গভাবে এটি বাস্তবায়িত হয়নি। নতুন সরকারের মতে, এই প্রকল্পও মূলত দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রচারের অংশ হয়ে উঠেছিল। তাই এটি অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হচ্ছে।
‘বীরের কণ্ঠে বীরগাঁথা’ প্রকল্পটি মূলত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা সংরক্ষণ ও সংকলনের জন্য পরিকল্পিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান চিরস্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের মাধ্যমে মূলত নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ছবি, বীরদের জীবনকাহিনি ও সংগ্রামের চেতনাকে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য ছিল।
প্রকল্পের আওতায় কিছু মূল কার্যক্রম নির্ধারিত হয়েছিল, এর মধ্যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ: খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়ার মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত বীরত্বগাথা সংগ্রহ করা।
ভিডিও ডকুমেন্টারি: সংগ্রহকৃত তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ ও বীরত্বগাথাকেন্দ্রিক ভিডিও ডকুমেন্টারি তৈরি করা।
প্রকাশনা:
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনকাহিনি ও স্মৃতিচারণ সংকলিত করে বিভিন্ন প্রকাশনা হিসেবে ছাপানো, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐতিহাসিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।
প্রকল্পটি শুরু হলেও নানা কারণে পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। কিছু নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন হয়েছিলÑ যেমন সাক্ষাৎকার, কিছু ভিডিও ডকুমেন্টারি তৈরি এবং সীমিত পরিমাণ প্রকাশনা প্রকাশ।
নতুন সরকারের মতে, প্রকল্পটি আদতে স্বাধীনভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্দেশ্য নয়। বরং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও দলীয়করণের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। প্রকল্পটির মাধ্যমে দলীয় প্রচার চালানোর চেষ্টা ছিল, যা প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণের চেতনাকে ক্ষুণœ করেছিল। এই কারণে নতুন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রকল্পটিকে আর এগিয়ে নেওয়া হবে না এবং অসমাপ্ত অবস্থাতেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হচ্ছে।
মূলত এ প্রকল্প ইতিহাস সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হলেও রাজনৈতিক প্রভাব ও পরিকল্পনার ঘাটতি প্রকল্পটির বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। যদিও কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে, প্রকল্পের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। নতুন সরকার এটি বন্ধ করার মাধ্যমে প্রকল্পটিকে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত ইতিহাস সংরক্ষণের দিক থেকে পুনর্বিবেচনার সুযোগ রাখছে।
প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয় ৪৯ কোটি ৫৭ লাখ ৫ হাজার টাকা। দেশব্যাপী ৮০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার রেকর্ড, ৮০ হাজার ভিডিও কনটেন্ট ইউটিউবে আপলোড, ১৬টি পূর্ণাঙ্গ তথ্যচিত্র নির্মাণ এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ পর্যন্ত ১২ হাজার ৭৮৮ জন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার ভিডিও ধারণ ও একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ছিল প্রায় ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ, যা ৫ কোটি ৫৮ লাখ ২৫ টাকার সমপরিমাণ।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সংশ্লিষ্টদের মতামত :
পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রকল্পগুলো ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তবায়নের ধারা দলীয়করণের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই সরকার মনে করছে, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া ঠিক হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভিত্তি। কিন্তু যখনই তা দলীয়করণ হয়, তখন ইতিহাস বিকৃতির ঝুঁকি তৈরি হয়। সরকার যদি প্রকল্পগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে বিকল্পভাবে একটি সর্বদলীয় ঐকমত্যভিত্তিক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নেওয়া উচিত।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) মো. শফিউল্লাহ মনে করেন, যেকোনো সরকারই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা করতে দায়বদ্ধ। প্রকল্প বন্ধ করলে সেটা যেন মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা না হয়। বরং আরও স্বচ্ছ ও দলনিরপেক্ষভাবে নতুন উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন