ঢাকা সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

পাওনা চায় বাংলাদেশ, উল্টো সুর পাকিস্তানের

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ২৪, ২০২৫, ১১:৪৫ পিএম
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের বৈঠক (রোববার, ২৪ শে আগস্ট)। ছবি- পিআইডি

পাকিস্তানের কাছে স্বাধীনতার আগের পাওনা ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার ফেরত চায় বাংলাদেশ। এই অর্থের মধ্যে ১৯৭০ সালের ভোলা সাইক্লোনের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সাহায্যও রয়েছে। এ ছাড়া আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভক্ত সম্পদের সুষম বণ্টন এবং ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়ার দাবি দীর্ঘকাল থেকে করে আসছে বাংলাদেশ। কিন্তু কোনোভাবে এসব যৌক্তিক দাবিতে সায় দিচ্ছে না পাকিস্তান। একাত্তর ইস্যু দুইবার সমাধান হয়েছে দাবি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। অমীমাংসিত ইস্যু এড়িয়েই সম্পর্কোন্নয়ন চায় দেশটি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের এবারের ঢাকা সফরে একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে দ্বিমত ছিল দুই পক্ষের। এর মধ্যেই সম্পর্কোন্নয়নে কিছু চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। তবে তাতে বাংলাদেশের তেমন লাভ দেখছেন না বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। 

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন গত শনিবার। ঢাকা সফরে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনসহ বিভিন্ন নেতার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক  করেন। এ সময় স্বাক্ষর হয় পাঁচটি সমঝোতা স্মারক ও একটি চুক্তি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক একটি বৈঠক। ওই বৈঠকে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একমত হয়েছে বলে জানানো হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। উভয়পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলো পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। তবে ১৯৭১ সালের অমীমাংসিত ইস্যু আগে দুইবার সমাধান হয়েছে বলে দাবি করেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। যার বিপরীতে দ্বিমত পোষণ করা হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। 

গতকাল রোববার ঢাকা সফররত পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলন করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ সময় তৌহিদ হোসেন বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করেন না যে, ৫৪ বছরের সমস্যা আজকের (গতকাল) এক দিনের মিটিংয়ে, যে মিটিংটা গত ১২ থেকে ১৩ বছর পর, তাও আবার হিনা রব্বানির দাওয়াত দেওয়ার জন্য এসেছিলেন, দ্বিপাক্ষিক সফর ছিল না- এখানে বসে আমরা এক ঘণ্টায় সমাধান করে ফেলতে পারব। এটা নিশ্চয়ই কেউ আশা করবেন না। আমরা পরস্পরের অবস্থান তুলে ধরেছি।

তিনি বলেন, আমি আপনাদের এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, একটি বিষয়ে শুধু কথা হয়েছে যেটাকে খানিকটা অগ্রগতি হিসেবে ধরে নিতে পারেন। আমরা তিনটি বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছি। দুই পক্ষ একটি বিষয় ঠিক করেছি, যেটা আমাদের সমাধান করতে হবে, সেটি হলো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যাতে খুব স্মুথলি এগোতে পারি। এ জন্য এগুলো পেছনে ফেলতে হবে। 

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, দুই পক্ষ এ নিয়ে সম্মত হয়েছে। আমরা এ নিয়ে কথা বলব এবং চেষ্টা করব, এই ইস্যুগুলো যেন আগামীতে বা কোনো একপর্যায়ে সমাধান করা যায়। আমরা এটা নিয়ে আলাদা করে এমনভাবে কথা বলব যাতে করে এই জিনিসগুলোকে পেছনে ফেলতে পারি। এ ছাড়া, আমরা পরস্পর নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছি।

অমীমাংসিত বিষয়ে দুই দেশের অবস্থান একই কি না- জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, অমীমাংসিত বিষয়ে দুই দেশ নিজেদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। একটি শুধু অগ্রগতি মনে করি, আমরা দুই পক্ষ একমত হয়েছি যে, এই বিষয়গুলো আলোচনা করে সমাধান করা প্রয়োজন, যাতে করে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এগুলো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।

এ সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের বক্তব্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করে উপদেষ্টার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ইসহাক দার বলেছেন, একাত্তর ইস্যুতে এর আগে দুইবার সমাধান হয়েছে। ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি এবং ২০০২ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পারভেজ মোশাররফের দুঃখ প্রকাশÑ এ বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশ একমত কি না? জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আমি অবশ্যই একমত না। একমত হলে তো সমস্যাটার সমাধান হয়ে যেত তাদের মতো করে। আমি তো বলেছি, আমরা আমাদের অবস্থান বলেছি, ওনারা ওনাদের অবস্থান বলেছে। বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা চাই হিসাবপত্র হোক, যেটা টাকা-পয়সার ব্যাপার, সমাধান হোক। আমরা চাই, এখানে যে গণহত্যা হয়েছে সেটার ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করুক, মাফ চাক। আমরা চাই, আটকেপড়া মানুষগুলোকে তারা ফেরত নেবে। আমি বাংলাদেশের অবস্থান শক্তভাবে তুলে ধরেছি।

পাকিস্তানের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক হচ্ছে। এটা তৃতীয় দেশ বিশেষ করে চীনের ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের কারণে কি নাÑ জানতে চাইলে তা নাকচ করে তিনি বলেন, ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থাটাতে চীনের উৎসাহ আছে, পাকিস্তানেরও উৎসাহ আছে। আমরা তো বলেছি, আপনারা আরও দেশকে নিয়ে আসেন, আমরা একসঙ্গে বসি। আমাদের অবস্থান সেই একই আছে। এটার কারণে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করছি তা নয়।

বিগত সরকারের সময় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গত সরকারের আমলে ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছিল। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই এবং অন্যান্য বন্ধু দেশের সঙ্গেও চাই; এর চেয়ে বেশি কিছু না।

এর আগে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একটি চুক্তি এবং পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। একমাত্র যে চুক্তিটি সই হয়েছে সেটি হলোÑ দুই দেশের সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ চুক্তি। আর যেসব বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে সেগুলো হলোÑ দুই দেশের বাণিজ্যবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন, সংস্কৃতি বিনিময়, দুই দেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা, দুই দেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার (বাসস ও এপিপিসি) মধ্যে সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সঙ্গে পাকিস্তানের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদের (আইএসএসআই) সহযোগিতা।

একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যু আগে দুইবার সমাধান হয়েছে : ইসহাক দার

একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যু আগে দুইবার সমাধান হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ইসহাক দার। এ সময় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যাসহ অমীমাংসিত ইস্যুর বিষয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা। জবাবে ইসহাক দার বলেন, ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ও ২০০২ সালে পারভেজ মোশাররফের সফরে দুঃখ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সমাধান হয়। তিনি গোটা পাকিস্তান জাতির পক্ষ থেকে গোটা বাংলাদেশ জাতির উদ্দেশে কথাটা বলেছিলেন। 

তিনি বলেন, আমি মনে করি, পরিবারের মধ্যে, দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো কিছুর একবার সমাধান হলে, সেটা হয়ে গেছে। ইসলাম বলেছে, হৃদয় পরিষ্কার করতে। আপনারা আপনাদের হৃদয় পরিষ্কার করুন। আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

ইসহাক দার বলেন, দুই দেশের মানুষের জন্য আরও ভালো কিছু করার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই। এটাতেই আমাদের ঐকমত্য এবং আমরা সেটাই করছি। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আমরা বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তা প্রতিরক্ষায় একযোগে কাজ করাসহ পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছু। তিনি বলেন, আপনাদের সঙ্গে আমাদের ঐকমত্য আছে, আমাদের মতামতে কোনো ভিন্নতা ছিল না। যা খুবই ভালো বিষয়।

একাত্তর ইস্যুতে ইসহাক দারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন তৌহিদ হোসেন

তবে ইসহাক দারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এ সময় বলেন, দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আগামী দিনে উভয় পক্ষই আলোচনা চালিয়ে যাবে। আমরা বৈঠকে পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুতে নিজ নিজ অবস্থান ব্যক্ত করেছি। তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য দুই পক্ষই একমত হয়েছি।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৫৪ বছরের অমীমাংসিত ইস্যু এক দিনে সমাধান হয়ে যাবে না। যে মিটিংটা ১৩ বছর পর হয়েছে, এখানে বসে এক ঘণ্টায় সমাধান করে ফেলব, আপনারা এটা আশা করবেন না। তিনি বলেন, আমরা পরস্পরের অবস্থানটা তুলে ধরেছি। আমরা একটা বিষয়ে একমত হয়েছি, এসব ইস্যুর সমাধান হলে আমরা সামনে এগোতে পারব। দুই পক্ষই একমত হয়েছি, এই ইস্যুতে আগামীতে কথা বলব।

চীনা উদ্যোগে ত্রিপক্ষীয় জোটের ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ছে কি নাÑ জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে চীনের উৎসাহ আছে, পাকিস্তানেরও আছে। তবে আগের সরকারের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছিল। আমরা চাই, অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক রয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গেও তেমন থাকবে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে ১৯৭১ সালের গণহত্যা প্রসঙ্গ উঠেছিল কি নাÑ জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, বিষয়টি আমার ওপর ছেড়ে দিন।  

ঢাকা সফরের প্রথম দিন গত শনিবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ও এনসিপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া পাকিস্তান হাউসে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।