ঢাকা মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫

পিপিআরসির প্রতিবেদন তিন বছরে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে ১০ শতাংশ

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৫, ০৬:৫৯ এএম

তিন বছরের ব্যবধানে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো। দেশে এখন দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। তবে ২০২২ সালে এই হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর বাইরে ১৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্য সীমায় নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। 

একইসঙ্গে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম (উচ্চ মূল্যস্ফীতি) ও শিক্ষার ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে দুটি বিষয়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হিসেবে দেখছে অধিকাংশ পরিবার। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) গতকাল সোমবার এই গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে। ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেবেল ইন মিড-২০২৫’ শিরোনামের গবেষণা ফল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডি মিলনায়তনে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সংস্থার নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।

মুল্যস্ফীতি, সীমিত কর্মসংস্থান ও সুশাসনের দুর্বলতা কীভাবে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং জনমতকে প্রভাবিত করছে জরিপটি তার একটি স্পষ্ট চিত্র।

জরিপের ফল অনুযায়ী, ৬৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ পরিবার মনে করে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। দৈনন্দিন জীবনে মূল্যস্ফীতির চাপ তীব্র হয়ে উঠেছে। শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়েও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। জরিপের আওতায় আসা প্রায় ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ পরিবার জানায়, শিশুদের শিক্ষার মান নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ০১ শতাংশ বিশেষভাবে শিক্ষার ব্যয় বৃদ্ধিকে উল্লেখ করেছে। এ ছাড়াও ২৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ পরিবার ভবিষ্যতে সন্তানের বিবাহ ব্যয় নিয়েও চিন্তিত।

দেশের ৮ হাজার ৬৭ পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে গত ৮ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত গবেষণাটি করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে পিপিআরসি বলেছে, দেশে তিন ধরনের সংকটের প্রভাব চলমান। এগুলো হলোÑ কোভিড (২০২০-২২), মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। সব মিলে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে ১০ শতাংশ।

২০২২ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। আর অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সেই হিসাবে পিপিআরসির সমীক্ষায় দেশে দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যÑ দুটিই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। একই সঙ্গে, অতি দারিদ্র্যের হার তিন বছর আগের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ হয়েছে।

জুলাই বিপ্লব শেষে গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে পিপিআরসি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের আগস্টের পর ঘুস কমেছে। গবেষণায় অংশ নেওয়া উত্তরদাতাদের মধ্যে গত বছরের আগস্ট মাসের আগে ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ সেবা নিতে ঘুস দিয়েছেন। আগস্ট মাসের পর এই হার ৩ দশমিক ৬৯-এ নেমে এসেছে। এখনো সবচেয়ে বেশি ঘুস দেওয়া হয়েছে সরকারি অফিসে। এরপর পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের বেশি ঘুস দিয়েছে মানুষ। এ ছাড়াও পরিবারের আয়ের ৫৫ শতাংশ চলে যায় খাদ্যপণ্য কেনার পেছনে।

গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে আয়ের ঘাটতিÑ যা ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার মনে করে। এ ছাড়াও ২৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ পরিবারে রয়েছে মূলধনের অভাব। অর্থনৈতিক চাপের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা নিয়েও তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ৫১ দশমিক ৬৫ শতাংশ পরিবার ওষুধের চড়া দাম, ৫০ দশমিক ৬৪ শতাংশ উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় এবং ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ চিকিৎসকের দেওয়া অপ্রয়োজনীয় মেডিকেল টেস্টকে বোঝা হিসেবে দেখছে।

সামাজিক সমস্যাগুলোও পারিবারিক পর্যায়ের শীর্ষ উদ্বেগের তালিকায় রয়েছে। এর মধ্যে মাদকাসক্তি (৫৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ) এবং কিশোর অপরাধ (৫৪ দশমিক ৫২ শতাংশ) সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। এরপর রয়েছে পারিবারিক ও পাড়াপড়শির বিরোধ (৪৩ দশমিক ১৩ শতাংশ)।

রাজনৈতিক ও সুশাসনসংক্রান্ত সমস্যাও কম নয়। প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা (৪৯ দশমিক ০৫ শতাংশ) বলেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব উদ্বেগের বিষয়। এ ছাড়া ৩৭ দশমিক ১১ শতাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ এবং ৩৬ দশমিক ২৩ শতাংশ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সীমাবদ্ধতাকে সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুশাসনের ক্ষেত্রে ৪৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ আইনশৃঙ্খলার অবনতিকে, ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিকে এবং ৩৩ দশমিক ১৩ শতাংশ ঘুস ও চাঁদাবাজিকে উদ্বেগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

অনুষ্ঠানে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্র গড়তে মানুষের জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সে বিবেচনা থেকে নীতি পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। প্রায়ই বিভিন্ন আলোচনায় অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা বলা হয়, তবে জনগণের হয়রানির কথা বলা হয় না। অথচ হয়রানির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের গতি কমে যায়। 

তিনি আরও বলেন, এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতির পরিকল্পনায় জনমুখী দৃষ্টি থাকা খুবই জরুরি। শুধু জিডিপির ওপর আলোচনাটা সীমাবদ্ধ না রেখে সমতা, ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা ও নাগরিকের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা বাড়াতে হবে। অথচ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও বেসিক অর্থনীতির তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

জরিপের ফল অনুযায়ী, ৬৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ পরিবার মনে করে মূল্যবৃদ্ধি তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা; এর ফলে স্পষ্ট হয়েছে যে, দৈনন্দিন জীবনে মূল্যস্ফীতির চাপ কতটা তীব্র হয়ে উঠেছে। শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়েও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা তীব্র আকার ধারণ করেছে।