ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৫

আস্থার সংকট দূর না হলে বিমা খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৫, ০৬:৩৮ এএম
বিমা

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বিমা খাত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এ খাত নানা চ্যালেঞ্জ, অনিয়ম ও আস্থার সংকটে ভুগছে। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার, আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল রূপান্তর এবং গ্রাহকসেবার মানোন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। বিমা খাতে আস্থা ফেরাতে কাজ করছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম বিমা খাতের নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে।

রূপালী বাংলাদেশ: আস্থার সংকট বিমা খাতের প্রধান সমস্যা। এই সংকট নিরসনে আপনারা কি ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন।

এম আসলাম আলম: দীর্ঘদিনের সুশাসনের অভাবে বিমা খাতে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। রাতারাতি এটা থেকে উত্তরণ করা যাবে না। এর সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য আইনগত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। বিগত সময়ে আইডিআরএ যথাযথভাবে বিমা কোম্পানিগুলোর তদারকি বা সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কারণ বিমা আইন এমনভাবে তৈরি করা, যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ক্ষমতায়িত করা হয়নি। নিয়ন্ত্রণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখা হয়েছে। অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে জরিমানা করা ছাড়া তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। জরিমানার টাকাটাও খুব সামান্য। একটা কোম্পানির পর্ষদ খারাপ কাজ করে যাচ্ছে অথচ সে পর্ষদকে আমরা অপসারণ করতে পারি না। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের কাছে পর্ষদ অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান কে হচ্ছেন, পর্ষদে কারা আসছেন, এসব বিষয়ে আইডিআরএর অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ব্যাংকের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব না। দুর্নীতি, অনিয়ম বহু কিছু হচ্ছেÑ কিন্তু আইডিআরএ কিছু করতে পারছে না। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে মূলত আইডিআরএ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে আজকে এ অবস্থার তৈরি হয়েছে। এটা থেকে বের হতে হলে প্রথমত আইনগত সংস্কার করে আইডিআরএকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। দ্বিতীয়ত জনবল ও সম্পদ বাড়াতে হবে। আইডিআরএকে যে শুধু আইনগতভাবে পঙ্গু করা হয়েছে, তা নয় আর্থিকভাবেও পঙ্গু করা হয়েছে। কোম্পানির নিবন্ধন নবায়ন ফির ক্ষেত্রে শতকরা ৩৫ পয়সা আইডিআরএকে দিতে হতো, সেটি কমিয়ে ১০ পয়সা করা হয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে। এ ছাড়া কোম্পানিগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে আইন না মানার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এজন্য ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং বিমাকারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা রয়েছে। সবাইকে মিলে এটা করতে হবে। আইডিআরএ-এর একার পক্ষে সম্ভব নয়। আস্থার সংকট দূর না হলে বিমা খাতের উন্নয়ন হবে না। 

রূপালী বাংলাদেশ: ঝুঁকিতে থাকা বিমা কোম্পানির বিষয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?

এম আসলাম আলম: ঝুঁকির ক্ষেত্রে আমরা সাতটি মানদ- চিহ্নিত করেছি, যার ভিত্তিতে কোম্পানিগুলোকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে প্রিমিয়ামের প্রবৃদ্ধির হার কেমন, লাইফের ক্ষেত্রে পলিসি নবায়নের অনুপাত ও নন-লাইফের ক্ষেত্রে দাবির অনুপাত, মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা, ব্যবস্থাপনা ব্যয়, শীর্ষ কর্মকর্তাদের পেশাগত যোগ্যতা এবং আইন ও বিধিবিধান পরিপালন। এ মানদ-গুলোর ওপর ভিত্তি করে আমরা মূল্যায়ন করছিÑ একটি প্রতিষ্ঠান কতটুকু ঝুঁকিতে রয়েছে। এক্ষেত্রে যেসব বিমাকারী প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করছি, এরই মধ্যে সেগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কী কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে, কারা এজন্য দায়ী, সেগুলো নিরীক্ষায় চিহ্নিত করা হবে। চিহ্নিত করার পর তাদের বিষয়ে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে এবং অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, নিরীক্ষায় উঠে আসার বিষয়ে বিমাকারীর রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুসারে ব্যবস্থা নেব। এ অধ্যাদেশ অনুসারে অকার্যকর হয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিগ্রহণ, একীভূতকরণ, রূপান্তরের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা হবে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থায়নের প্রয়োজন হবে, যা বিদ্যমান ও নতুন শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে নেওয়া হবে। সরকারের কাছ থেকেও আমরা আর্থিক সহায়তা চাইব। অন্যদিকে যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো কার্যকর কিন্তু অব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা যেসব আইনি সংস্কার করছি। যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করব। আমরা আশাবাদী যারা অফট্র্যাকে চলে যাবে তাদের অনট্র্যাকে নিয়ে আসতে পারব।

রূপালী বাংলাদেশ: দেশের বিমা খাতে গত এক বছরে কী ধরনের সংস্কার হয়েছে?

এম আসলাম আলম: আমাদের প্রধান দায়িত্বই হলো সংস্কার করা। সংস্কারের জন্যই দায়িত্ব নিয়েছি। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা ব্যাপকভাবে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের মূল সংস্কার কার্যক্রমগুলোকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। আইনগত সংস্কার, ডিজিটাল সংস্কার ও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং বা প্রশাসনিক সংস্কার। আইনগত সংস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ বিমা আইন, বিমাকারীর রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন আইন এবং কর্তৃপক্ষ আইন। এ চারটা আইন বিমা শিল্পের মেরুদ-। এগুলোর খসড়া করে ওয়েবসাইটে দিয়েছি, অংশীজনদের মতামত নিচ্ছি। মূল আইনগুলোর বাইরেও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধিবিধান সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। যেমন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধান-২০১২। এ মুহূর্তে ১৯টি কোম্পানিতে সিইও নেই। আমরা একটি সিইও পুল তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, সেখানেও আমরা পর্যাপ্ত আবেদন পাইনি। যে আবেদন পেয়েছি তার মধ্যে নন-লাইফে মাত্র একজনকে পুলভুক্ত করতে পেরেছি। আর লাইফে ১৬টি আবেদনের মধ্যে মাত্র চারজনকে পুলভুক্ত করতে পেরেছি। 

জীবন বিমা কোম্পানির ক্ষেত্রে এজেন্ট নিয়োগ ও নবায়ন বড় সমস্যা। এটা সমাধানে প্রবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। বিমা জরিপকারী নিয়োগ নন-লাইফের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এটারও খুবই বাজে অবস্থা। এটাও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। তারপর লাইফ ও নন-লাইফে উভয় ক্ষেত্রে দাবি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে নিষ্পত্তির জন্য যে কমিটি রয়েছে, সে কমিটির প্রবিধানেও সমস্যা রয়েছে। আমরা এটাও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। ২০১০ সালে বিমা আইন হলেও কোম্পানিগুলোর সলভেন্সি মার্জিনের ওপর রেগুলেশন ছিল না, আমরা উদ্যোগ নিয়ে এরই মধ্যে সেটি সম্পন্ন করেছি। এ ছাড়া ডিজিটাল সংস্কারের আওতায় আইডিআরএর অভ্যন্তরীণ কাজ একটি এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্লানিংয়ের মাধ্যমে করার জন্য দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা ১৪টি মডিউল বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব। এ ছাড়া রেগুলেটরি টেকনোলজি সলিউশনের আটটি মডিউল বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি, যার মাধ্যমে আমরা বিমা কোম্পানিগুলোকে ডিজিটাল রেগুলেটরি সার্ভিস দিতে পারব।

সুপারভাইজরি টেকনোলজি সলিউশনের আওতায় সাতটি মডিউল রয়েছে। এর মাধ্যমে বিমা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিপোর্ট পেয়ে যাব। পাশাপাশি এর মাধ্যমে ফ্রড ডিটেকশনও করা যাবে। প্রশাসনিক সংস্কারের মধ্যে বিমা খাতের মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ চার্টার্ড ইন্স্যুরেন্স ইনস্টিটিউট তৈরির জন্য আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্স্যুরেন্স ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিমা খাতে ব্যাপকভাবে দক্ষতার সংকট রয়েছে। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিআইএম প্রতিষ্ঠা করা হবে। বাংলাদেশ অ্যাকচুরিয়াল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিমা খাতে মনিটরিং, সুপারভাইজিং ও গাইডেন্স বাড়ানোর জন্য বিদ্যমান জনবল তিনগুণ বাড়াতে চাইছি। পাশাপাশি আমাদের কর্মীদের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

রূপালী বাংলাদেশ: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?

এম আসলাম আলম: আমরা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সব সংস্কারই সম্পন্ন করতে চাই, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণ কাঠামোসংক্রান্ত সংস্কারগুলো। ডিজিটাল অবকাঠামোও এ সময়ের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ন্যাশনাল কোর ইন্স্যুরেন্স সলিউশন সিস্টেম ডিসেম্বরের মধ্যে সম্ভব নয়, এটি ২০২৬ সালের মধ্যে করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাইভেট রিইন্স্যুরার তৈরি করা, বিদেশি কোম্পানিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার মতো কাজগুলো আগামী বছরের মধ্যে করতে চাই।

রূপালী বাংলাদেশ: ব্যাংকের মতো বিমা কোম্পানির একীভূতকরণ সম্ভব কি-না?

এম আসলাম আলম: একীভূতকরণের জন্য আগে আমাদের বিমাকারীর রেজল্যুশন অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে হবে। এটি আমরা এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করব। তারপর সামনের বছর এ রেজল্যুশনের ভিত্তিতে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন শুরু হবে। রেজল্যুশন প্রণয়নের আগে একীভূতকরণের জন্য আমাদের কাছে ক্ষমতাই নেই। তাই এটি আগে করা প্রয়োজন।

রূপালী বাংলাদেশ: দেশে স্বাস্থ্যবিমার পরিধি বিস্তৃত করতে আইডিআরএর কি ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে?

এম আসলাম আলম: বিমা খাতের নতুন সীমান্ত হচ্ছে স্বাস্থ্যবিমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। গ্রুপ স্বাস্থ্যবিমা ও একক স্বাস্থ্যবিমা দুটোর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে গ্রুপ স্বাস্থ্যবিমা মোটামুটি প্রচলিত আছে। তবে একক স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন খুব বেশি নেই। এক্ষেত্রেও ঘুরেফিরে আস্থা সংকটের কারণে মানুষ আগ্রহী হচ্ছে না। আবার বিমা কোম্পানিগুলোও একক স্বাস্থ্যবিমার প্রসারে আগ্রহ দেখায় না। এক্ষেত্রে আমরা যদি স্বাস্থ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মিলে একটি কাঠামো দাঁড় করাতে পারি, তাহলে এখানে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো দূর করা সম্ভব। ইন্স্যুরটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাস্থ্যবিমা বাজারজাত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। মাইক্রো ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ন্ত্রক কাঠামো নেই। মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স বিমা কোম্পানির জন্য নতুন একটি বাজার হিসেবে অপেক্ষা করছে। নন-লাইফ বিমা খাত বাধ্যতামূলক অগ্নি ও নৌবিমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিনাশ্রমেই এটি পাওয়া যায়। অথচ আবাসিক ও প্রতিটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেরই অগ্নি বিমার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু কেউ এটি করার জন্য বিমা কোম্পানিগুলোর দিক থেকে কোনো চেষ্টা নেই। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনকে (বিআই) সঙ্গে নিয়ে বিমা কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন পণ্য চালুর পাশাপাশি বিদ্যমান পণ্যের বাজার বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।