বাংলাদেশি তরুণদের কাছে ইউরোপ এক স্বপ্নরাজ্য। উন্নত জীবনযাপন, স্থায়ী কর্মসংস্থান, সামাজিক মর্যাদাসহ একাধিক কল্পনা তাদের চোখে এক মোহময় ভবিষ্যৎ আঁকে। কিন্তু এই স্বপ্নই অনেক সময় পরিণত হয় মর্মান্তিক মৃত্যুযাত্রায়। ভারত, নেপাল, দুবাই, লিবিয়া কিংবা তিউনেশিয়া হয়ে ইউরোপের অবৈধ পথে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা এখন এক ভয়ংকর মানবপাচার চক্রের হাতে বন্দি। যারা এই যাত্রায় নামেন, তাদের বেশির ভাগই গ্রেপ্তার বা মৃত্যুর মুখে পতিত হন।
বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে সুসংগঠিত মানবপাচার সিন্ডিকেট। গ্রামের অশিক্ষিত বা আধা শিক্ষিত তরুণদের ‘ইউরোপে গেলে সব সমস্যার সমাধান’Ñ এমন প্রলোভন দেখানো হয়। পরিবারের স্বপ্নও এতে জড়িয়ে পড়ে। পাচারকারীরা প্রথমে তাদের ভারতে বা নেপালে পাঠায়, সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া বা তিউনেশিয়ায় নিয়ে যায়। অনেক সময় এ দেশগুলোতেই তাদের আটকের পর নির্যাতন করা হয় এবং পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
যারা মুক্তিপণ দিয়ে বেঁচে যান, তাদের সামনে আসে সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায়। ভূমধ্য সাগর পাড়ির খেলা। ২০ জন যাত্রী ধারণক্ষম নৌকায় তোলা হয় ১০০ জনকে। নৌকার কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই, খাদ্য বা পানির সঠিক ব্যবস্থা নেই। মাঝপথে নৌকা ডুবে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভূমধ্য সাগরে অন্তত ২৭ হাজারেরও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যাও হাজার ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অনেক যুবক ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন। ২০১৯ সালে লিবিয়া উপকূলে নৌকা ডুবে একসঙ্গে ৭৫ জনের মৃত্যু, যার মধ্যে ৩৭ জনই ছিলেন বাংলাদেশি। এই ঘটনাটি গোটা জাতিকে নাড়া দিয়েছিল। কাজের সন্ধানে দেশের গ্রাম থেকে শহর, সেখান থেকে সাগর পেরিয়ে প্রাণ হারানোর এই প্রবণতা থামছে না।
ইউরোপের উদ্দেশে যারা যাত্রা করেন, তাদের অন্তত ৯৫ শতাংশের ভাগ্য ব্যর্থতায় গড়ায়। কেউ গ্রেপ্তার হন ইতালি, গ্রিস বা মাল্টার সীমান্তে; কাউকে ফেরত পাঠানো হয় লিবিয়ার বন্দিশিবিরে; আবার কেউ সমুদ্রেই প্রাণ হারান। যারা ভাগ্যক্রমে ইউরোপে পৌঁছান, তাদেরও বেশির ভাগই দীর্ঘদিন শরণার্থী শিবিরে অনিশ্চিত জীবন কাটান। কাজের সুযোগ সীমিত, বৈধ পরিচয় পাওয়াও কঠিন। ফলে প্রতিশ্রুত ‘স্বপ্নের ইউরোপ’ বাস্তবে পরিণত হয় শ্বাসরুদ্ধকর সংগ্রামে।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যখন ঝুঁঁকি এত প্রকট, তখন কেন তরুণেরা জীবন বাজি রেখে সমুদ্রপথে যাত্রা করেন?
এর সরল ও সত্য উত্তর, দেশে বেকারত্বের উচ্চ হার, বিশেষত তরুণদের মধ্যে। সেইসঙ্গে দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্যসহ একাধিক সমীকরণই তরুণদের ঠেলে দিচ্ছে অবৈধ ও বিপজ্জনক পথের দিকে।
মানবপাচার বন্ধে আন্তর্জাতিক মহল বারবার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও আইন ও কূটনৈতিক চ্যানেলে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে বাস্তব চিত্র হলোÑ পাচারকারীরা গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সক্রিয়, আর প্রতিদিনই নতুন নতুন তরুণ এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন। তাই কার্যকর প্রতিরোধে প্রয়োজন, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা ও বিচার নিশ্চিত করা, বৈধ অভিবাসনের পথ সহজ ও স্বচ্ছ করা, স্থানীয় পর্যায়ে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি এবং পরিবার ও সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
ইউরোপ-স্বপ্ন যেন আর কারো সলিল সমাধি না হয়Ñ এই দায়িত্ব শুধু অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, সরকারের, ও সমাজের সবার। অবৈধ রুট বন্ধ, মানব পাচারকারীদের দমন, অভিবাসন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বৈধ অভিবাসনের পথ সুগম করাই হতে পারে এই মৃত্যুমিছিল বন্ধের একমাত্র উপায়। যারা সমুদ্রের অতলে হারিয়ে যাচ্ছেন, তারা শুধু সংখ্যা নন, তারা প্রত্যেকেই একজন বাবা, মা, ভাই, বোন কিংবা স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ। তাদের স্বপ্ন আর যেন জলে ডুবে না যায়।
ইউরোপগামী তরুণদের স্বপ্ন যদি এভাবেই বারবার মৃত্যুর সমুদ্রে ডুবে যায়, তবে তা শুধু ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় শোকও বয়ে আনে। আমাদের শ্রমশক্তি, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ বারবার হারিয়ে যাচ্ছে এক সলিল সমাধির অন্ধকারে। তরুণদের বাঁচাতে হলে এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। ইউরোপকে স্বপ্ন হিসেবে নয়, দেশকেই সম্ভাবনার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন