ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর, ২০২৫

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন

এ মাসেই প্রাথমিক প্রার্থী  তালিকা দেবে বিএনপি

রুবেল রহমান
প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৫, ১২:৩৬ এএম

দেরি করে হলেও প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ জোরেশোরেই করছে বিএনপি। চলতি মাসের মধ্যেই প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত করতে চায় দলটি। যদিও বিএনপির পুরোনো মিত্র বর্তমানে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে প্রায় এক বছর আগে। দেরি হলেও আর বিলম্ব করতে চায় না বিএনপিÑ এ লক্ষ্যে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব নানাভাবে কাজ করছেন বলে জানা যায় বিএনপি সূত্রে। তারা বলছে, নির্বাচন কবে হবে তার নিশ্চয়তা না পেয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে চায়নি তারা। বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করেন, তাদের দলে প্রার্থী অনেক বেশি, তাই সংকট হবে না প্রার্থিতা নিয়ে। বরং আগে প্রার্থী ঘোষণা করা হলে বাকিরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যত দেরি করে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে, দলীয় কোন্দল নিরসনে তত বেশি বেগ পেতে হবে। ফল বিপর্যয়ের কারণ মূলত হয় দলীয় কোন্দল না মেটানো। 

প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে অবশ্য নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বিএনপি। দলীয় প্রার্থী ঠিক করার পাশাপাশি সমমনা ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের আসন ছাড় ও মনোনয়নের বিষয়টিও দ্রুত সুরাহা করতে চাইছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। এ ক্ষেত্রে বেশি সময় নেওয়া হলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুযোগ নিতে পারে বলে মনে করছেন তারা। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এখন বিএনপির নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধপূর্ণ আসন বা এলাকাগুলোর দিকে। অর্থাৎ, যেসব আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি বা প্রার্থিতা নিয়ে সাংঘাতিক বিরোধ রয়েছে, যা মিটমাট না হলে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কা আছেÑ এমন এলাকাগুলোর দিকে। সে জন্য স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতাকে বিভাগভিত্তিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা দলের একক প্রার্থী নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আসনভিত্তিক সম্ভাব্য প্রার্থীদের একসঙ্গে গুলশানের কার্যালয়ে ডেকে কথা বলছেন। যদিও সম্ভাব্য প্রার্থীর সবারই দাবি, বিগত দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন তারা। জেল খেটেছেন দলের জন্য। তবে অভিযোগ আছে, পতিত ফ্যাসিবাদের দোসররাও বিএনপিতে ঢুকে পড়েছেন কায়দা-কানুন করে। তারাও চাইছেন দলীয় মনোনয়ন। পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ীদের নিয়েও বিপাকে বিএনপির ত্যাগী নেতারা।  

বিএনপির একটি সূত্র বলছে, গত সপ্তাহ থেকেই শুরু হয়েছে এই প্রার্থী বাছাই কার্যক্রম। ইতিমধ্যে কুমিল্লা, বরিশাল, রাজশাহী অঞ্চলের বেশ কিছু আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ ও সাংগঠনিক নেতারা কথা বলেছেন। এর মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেনকে বরিশাল ও কুমিল্লা বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিরোধপূর্ণ আসনগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কাজে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকেরা তাদের সহযোগিতা করছেন।

এটাকে প্রার্থী বাছাইয়ে নির্বাচন-পূর্ব ‘প্রাক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’ বলে মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেক এলাকায় আমাদের প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। কোনো কোনো আসনে চার-পাঁচজন কিংবা আরও বেশি। সেখানে সবাইকে ডেকে কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সবাইকে একসঙ্গে মনোনয়ন দেওয়া যাবে না, যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, সবাইকে তা মানতে হবে এবং তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। আমরা শরিকদের জন্য কিছু আসন ছাড়ব। সে জন্য নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করতে হবে। নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার আগে এ ধরনের অনেক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থাকে, এখন সেগুলোই করা হচ্ছে। তপশিল ঘোষণা হয়ে গেলে কোন্দল থাকবে না বলেই মনে করেন তিনি।  

এ জেড এম জাহিদ হোসেন গত সপ্তাহে চাঁদপুর-২ আসন (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ), ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া ও কসবা), বরিশাল-২ (উজিরপুর ও বানারীপাড়া), বরিশাল-৫ (বরিশাল সিটি করপোরেশন ও বরিশাল সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত) ও ঝালকাঠি-২ (সদর ও নলছিটি) আসনসহ আরও কয়েকটি সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর মধ্যে চাঁদপুর-২ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ছয়জনকে গুলশানের কার্যালয়ে ডাকা হয়। তারা হলেনÑ জালালউদ্দিন, এম এ শুক্কুর পাটোয়ারী, তানভীর হুদা, ওবায়দুর রহমান, শামীম আহমেদ ও সরকার মাহবুব আহমেদ। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের পদে থাকা এই ছয় নেতাই দলীয় মনোনয়নযুদ্ধে নেমেছেন। জালালউদ্দিন তার এলাকায় পরিচিত জালাল হাজি নামে। রূপালী বাংলাদেশের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের ত্রাস মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এলাকাছাড়া হয়েছিলেন। সে কারণে নমিনেশন পাওয়ার দাবিদার তিনি। 

ডাক পেয়ে গুলশানের কার্যালয়ে এসেছিলেন, এমন একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বৈঠকের মূল কথা হচ্ছে যেকোনো মূল্যে দলীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলছেন, প্রতিটি আসনেই দলে অনেক যোগ্য প্রার্থী আছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজনকেই মনোনয়ন দিতে হবে। এতে অনেকে মনঃক্ষুণœ হতে পারেন। কিন্তু দল যাকে মনোনয়ন দেবে, দলের স্বার্থে সবাইকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো কাজ করা যাবে না। বৈঠকে এ বিষয়ে সবাইকে একমতে আনতে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বৈঠকে সবাই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে তারা কেউ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবেন না। গত সোমবার গুলশানের কার্যালয়ে ডাক পেয়েছিলেন এমন একজন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ। তিনি বরিশাল-৫ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী। যেখানে বরিশালের সাবেক মেয়র ও বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারও সম্ভাব্য প্রার্থী। 

গত সোমবার বরিশাল মহানগর কমিটির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক, সদস্যসচিব জিয়াউদ্দিন সিকদারসহ এই আসনের চারজন নেতাকে গুলশানের কার্যালয়ে ডাকা হয়। এ ছাড়া বরিশাল-২ আসনে এস সরফুদ্দিন আহমেদ (সান্টু), দুলাল হোসেন, সাইফ মাহমুদ জুয়েল, কাজী রওনাকুল ইসলামকে বৈঠকে ডাকা হয়। ঝালকাঠি-২ আসনে মাহবুবুল হক (নান্নু) ও ইলেন ভুট্টো বৈঠকে উপস্থিত হন। আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। এটাই হচ্ছে দলের নির্দেশনা। আমি এর সঙ্গে সম্পূর্ণ ঐকমত্য পোষণ করেছি। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী তিনি। 

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত করা হতে পারে। এরপর ধাপে ধাপে সাক্ষাৎকার ও মূল্যায়নের মাধ্যমে দলের মনোনয়ন বোর্ড চূড়ান্ত প্রার্থী নির্ধারণ করবে। তবে তপশিল ঘোষণার পরই চূড়ান্ত করা হবে বিএনপির প্রার্থী তালিকা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী মনে করেন, বিএনপিকে এবার প্রার্থী বাছাইয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আন্দোলনের সময় বা দলের দুঃসময়ে যারা সক্রিয় ছিলেন, তাদের বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়ন দিলে তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দূরত্ব আরও বাড়বে। জামায়াত মুখে মুখে নির্বাচনে যাবে না বললেও এক বছর আগে থেকেই চূড়ান্ত করেছে প্রার্থীর তালিকা। তাদের দলে কোন্দল কম হবে খুব স্বাভাবিকভাবে। তা ছাড়া তাদের প্রার্থী ঘোষণার পর কেউ বিদ্রোহ করেছে, তেমনটি চোখে পড়ে না। তবে বিগত দিনে বিএনপির কোন্দল ছিল চোখে পড়ার মতো। এখনই কোন্দল না মেটাতে পারলে ভবিষ্যতে ফলাফল বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে দেশের সবচেয় বড় এই রাজনৈতিক দলকে। 

এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি তার মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি দ্রুত চূড়ান্ত করতে চাইছে। এ জন্য স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের কাছে তাদের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা চাইছেন দ্রুত শরিক বা মিত্র দলগুলোর মনোনয়নের কাজ চূড়ান্ত করতে, যাতে নির্বাচন ও প্রার্থিতা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তি কাটে এবং তারা নির্বাচনি এলাকায় কার্যক্রম শুরু করতে পারেন। যদিও প্রায় এক বছর আগে, গত বছরের অক্টোবরে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর ছয় নেতাকে এলাকায় জনসংযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে স্থানীয় নেতাদের অতীব জরুরি নির্দেশনা সংবলিত চিঠি দিয়েছিল বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কেবল নির্দিষ্ট কোনো বিভাগে নয়, সারা দেশেই দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা চলছে। তবে এখনই প্রার্থী চূড়ান্ত হচ্ছে না।